রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারের পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার সময় রোনা ম্যাকড্যানিয়েল তাঁর সহকর্মীদের অনুরোধ করেছিলেন, তাঁরা যেন তাঁর জায়গায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনীত দুজনকে বসানোর সিদ্ধান্তকে আন্তরিকভাবে মেনে নেন। পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার সময় তাঁকে বেশ উল্লসিতই মনে হচ্ছিল। উচ্চ স্বরে উল্লাস করার পর দলের কর্মী-সমর্থকদের রোনা বলেন, তিনি এতটাই আনন্দের সঙ্গে সরে যাচ্ছেন যে তাঁর পদত্যাগে সহকর্মীদের কারও আপত্তি আছে কি না, তা জিজ্ঞাসা করতেও তিনি আগ্রহ বোধ করছেন না।
আসলে এটি একটি দেখার মতো মুহূর্ত ছিল। খুব হাসিখুশির মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেখানে এক ব্যক্তির ইচ্ছাকে মেনে নেওয়া হচ্ছিল। বিশাল একটি রাজনৈতিক দলকে নিজের ইচ্ছার অধীনে কট্টর ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী নেতা ট্রাম্প একাই যে এনেছেন তা নয়, এই তালিকায় আরও অনেকে আছেন।
জনমোহিনীবাদী ও হবু স্বৈরাচারী নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্রের একটি সাধারণ ধরন হলো, তাঁরা দ্রুত দলের মূল চালিকা শক্তিগুলোকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই প্রবণতা একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সত্যিকার অর্থে ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাইমারি ইলেকশনে প্রার্থী মনোনয়ন করার ক্ষেত্রে দলের ভেতরে যে গণতন্ত্রচর্চা করা হয়, তা অনেক সময় কাঠামোগতভাবে সেই সব বিশুদ্ধতাবাদীর পক্ষে যেতে পারে, যাঁরা কট্টরপন্থী প্রার্থীদের পছন্দ করেন। দলের ভেতরকার এ ধরনের গণতন্ত্রচর্চা এমন লোকদের নেতৃত্বের শীর্ষে নিয়ে আসতে পারে, যাঁরা রাজনীতিকে একটি শখের বিষয় বলে মনে করেন। তবে দলের ভেতরে পাল্টাপাল্টি যুক্তি তুলে ধরা ও যুক্তিখণ্ডন ভালো নীতি ও আইডিয়ার জন্ম দেয়। এতে বিজয়ীদের মনে বিরোধীদের উপস্থাপন করা যুক্তি-প্রমাণ সম্পর্কে শক্তিশালী ধারণা থাকে। এতে বিজয়ীদের মধ্যে আন্তদলীয় বিতর্কে হেরে যাওয়া পক্ষগুলোকে সম্মান করার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।
ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টিতে এমন একটি ধারা চালু করে গেছেন, যার কারণে দলটি এখন আর আগের মতো নিয়মনিষ্ঠ প্রচারণা বা ইলেকশন ক্যাম্পেইনকেও গুরুত্ব দেয় না। ২০২০ সালের নির্বাচনের আগে, দলটি কেবল তার ২০১৬ সালের কর্মসূচিরই পুনরাবৃত্তি করেছিল। সে সময় দল ট্রাম্পের প্রতি অন্ধবিশ্বাস স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
কোনো গোষ্ঠী বা কোনো গোত্রের নেতারা তাঁদের অনুগামীদের এমনভাবে আদেশ দিতে পারেন, যা অনেক সময় সবচেয়ে ক্যারিশমাটিক রাজনীতিবিদও করতে পারেন না। রিপাবলিকান পার্টি সঠিক পথে চললে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল বিদ্রোহের আগেই ট্রাম্প এবং তাঁর কট্টর ভক্তদের থামানোর উপায় খুঁজে বের করতে পারত। এই ঘটনার পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পকে অভিশংসন করে রিপাবলিকানরা তাঁদের নিজস্ব নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল থাকার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারতেন।
যে দলের হাতে বাস্তবমুখী কর্মসূচি থাকে, সেই দল নির্বাচনী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে এবং পরের বার ভোটারদের তার পক্ষে আনার চেষ্টাকে দ্বিগুণ করতে পারে। এর জন্য এক ব্যক্তির স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে সুদূরপ্রসারী নীতি অবলম্বন করা দরকার। কিন্তু কিছু রাজনীতিবিদ এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের উত্তরাধিকারী হিসেবে গদিতে বসান। এই কায়দায় তাঁরা একটি দলকে একটি পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা একটি আধা রাজবংশীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন।
ভারতে কংগ্রেস পার্টিতে গান্ধী পরিবার এই কাজ করেছিল। এর মাধ্যমে তারা দলের জন্য তো বটেই, একই সঙ্গে ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে এনেছিল। ফ্রান্সে মারি লো পেন তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠা করা চরম ডানপন্থী দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পও পিছিয়ে নেই। তিনি রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির কো-চেয়ারের গদিতে কয়েক দিন আগে তাঁর পুত্রবধূ লারা ট্রাম্পকে বসিয়ে দিয়েছেন। এটি রিপাবলিকান পার্টিকে ট্রাম্পের পারিবারিক ব্যবসার মতো কিছু একটা করে তুলেছে।
কোনো গোষ্ঠী বা কোনো গোত্রের নেতারা তাঁদের অনুগামীদের এমনভাবে আদেশ দিতে পারেন, যা অনেক সময় সবচেয়ে ক্যারিশমাটিক রাজনীতিবিদও করতে পারেন না। রিপাবলিকান পার্টি সঠিক পথে চললে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল বিদ্রোহের আগেই ট্রাম্প এবং তাঁর কট্টর ভক্তদের থামানোর উপায় খুঁজে বের করতে পারত। এই ঘটনার পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পকে অভিশংসন করে রিপাবলিকানরা তাঁদের নিজস্ব নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল থাকার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারতেন।
এসব না করে রিপাবলিকান নেতাদের কেউ কেউ হয় পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলেছেন, নয়তো রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পর মুখ খুলেছেন। হাতে হাতে তার ফল মিলেছে। দলটি এখন প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী চিন্তার একজন নেতার একচ্ছত্র আধিপত্যে রয়েছে, যিনি এই পদটিতে বসার জন্য স্পষ্টতই অযোগ্য; অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় একটি দল নিজেই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে।
এটা শুধু ট্রাম্পের ক্ষেত্রেই ঘটছে, তা নয়। জইর বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কার্যত তাঁর নিজের কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না; সমমনা রাজনীতিবিদদের কাছেও তাঁর কোনো জবাবদিহি ছিল না। অন্যান্য চরম ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী নেতাদের দল আছে বটে, কিন্তু সেগুলো তাঁরা কঠোর স্বৈরাচারী কায়দায় চালান। দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের সামনে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে জারোস্লাভ কাচজিনস্কি পর্যন্ত আছেন। তাঁরা এমনভাবে তাঁদের নিজ নিজ দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা কাউকেই পরোয়া করেন না।
দলের গঠনতন্ত্রের বিধিমালায় কড়াকড়ি আরোপ এই অবস্থা থেকে হয়তো নিষ্কৃতি দিতে সহায়তা করতে পারে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার একটা সীমা আছে। কারণ, এটা দলের ভেতরকার নেতৃত্বকে দলাদলির দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা ভোটারদের দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করতে পারে। দলের ভেতরকার গণতন্ত্রচর্চার বাড়াবাড়ি অহেতুক ও দলের জন্য ক্ষতিকর বিতর্ককে উসকে দিতে পারে।
তবে তারপরও দলের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চার ঝুঁকি নেওয়া যে খুব দরকার, তা রিপাবলিকান পার্টির একটি কর্তৃত্ববাদী হাতিয়ারে রূপান্তর হওয়ার ঘটনাই আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে।
● জ্যঁ ভার্নার ম্যুলার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ