২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তবে সে প্রস্তুতি সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক। মূলত তা-ই হওয়ার কথা। তবে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো দাবি করছে, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। আগে পদত্যাগ করে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনেও পরিবর্তন আনার দাবি তাদের রয়েছে।
আরও লক্ষণীয় হচ্ছে, তাদের এ অবস্থান অনমনীয়। অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকা দল ও তাদের সহযোগীরা বলে চলছে, সংবিধানের আওতায়ই হবে নির্বাচন। এতে সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন কিংবা সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিধান নেই।
সরকারও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে—এমন কোনো নমুনাও দৃশ্যমান হয় না। স্পষ্টত বিপরীত অবস্থানে থাকা দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব হ্রাস করে একটি সমঝোতায় পৌঁছার কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। পরস্পরের মুখ-দেখাদেখি একরূপ বন্ধ। কোনো তৃতীয় পক্ষও কিছু একটা করতে তৎপর নয়। দেশের নাগরিক সমাজও দুর্বল হয়ে পড়েছে। দলীয়করণের চাপই এটাকেও দুর্বল করে ফেলেছে। তাদের অবস্থান গোলটেবিল, সেমিনার ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। বিদেশি কূটনীতিকেরা কিছু একটা করতে চাইলেও এখন পর্যন্ত ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তাহলে ধরে নিতে হয়, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আসছে না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোনো দলের অংশগ্রহণ বা বর্জনের ওপর চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেমে থাকতে পারে না। তারা মনে করে, জনগণ ব্যাপকভাবে অংশ নিলেই সেটাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে।
তাঁরা চাইলে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন সামনে রেখে যে বিপত্তি এসেছে, তা দূর করতে পারেন। তবে উভয় পক্ষকে এতে আগ্রহী হতে হবে। এমনটাই চায় এ দেশের লোক। নির্বাচন কমিশনকে দেশের শাসনব্যবস্থার নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বিধানগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জোরালো নমুনা লক্ষণীয় হচ্ছে না। এমন না হলে ভোট প্রশ্নবিদ্ধই থাকবে। আমাদের গন্তব্য হবে অনিশ্চিতের দিকে।
দেখা যায়, সাম্প্রতিক কালে সব দলের অংশগ্রহণে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট প্রায় সমান। এক-তৃতীয়াংশ হারে। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে। ভোটের সময় তারা কোনো না কোনো দল বা জোটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মূলত তাদের সমর্থনই নির্বাচনের ফলাফলের প্রধান নিয়ামক।
বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের সমর্থকদের ভোট দিতে যাওয়ার কথা নয়। কোনো খেলার মাঠে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে দর্শক-সমর্থকেরা দেখতে যায় না; ঠিক তেমনি নিরপেক্ষ ভোটারদেরও ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। এমনকি সরকারি দলের সমর্থকেরাও কেন্দ্রে যেতে ততটা উৎসাহী হন না। এমনটা দেখা গেছে সম্প্রতি গুলশানে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের একটি উপনির্বাচনে। সেখানে ভোট পড়ার হার ১০ শতাংশের নিচে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনটা হয়ে যেতে পারে একতরফা। উপস্থিতির হার যা-ই হোক, যাঁরা পরিচালনা করবেন, তাঁরা অতীতের ধারাবাহিকতায় প্রদত্ত ভোট ও ফলাফল নির্ধারণ করে দেবেন।
যেমনটা ১৯৭৯ ও ১৯৮৫ সালের গণভোট এবং ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্রে গেছেন নগণ্য ভোটার। কিন্তু ‘প্রদত্ত ভোট’ দেখানো হয় লাখ লাখ। অবশ্য সংবিধান ও জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে কতসংখ্যক ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে, এর কোনো ন্যূনতম সীমারেখা টানা হয়নি। এমনই পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্জন করলে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান সরকারি দল ও জোটের প্রার্থীরা।
২০১৮ সালে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তবে তারা নির্বাচনের আগে কিংবা ভোটের দিন যথাযথ প্রচার চালাতে সক্ষম হয়নি। এমনকি প্রায় সব ভোটকেন্দ্রে ছিল না তাদের কোনো এজেন্ট। তাদের কর্মী-সমর্থকেরা হয়েছিলেন কারারুদ্ধ কিংবা এলাকাছাড়া। অন্যদিকে, বিরোধী দলের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে জড়তা লক্ষ করা গেছে। তাদের প্রার্থীদের কেউ কেউ নির্বাচনে এলাকামুখী হননি। তবে যেকোনোভাবে গোটা দশেক আসন বিরোধী দল পেয়ে যায়। বাকি সবই সরকারি দল ও জোটের ঝুড়িতে। আইনগতভাবে এটা কতটা শুদ্ধ বলা যাবে, তা আইন অঙ্গনের ব্যক্তিরাই সঠিকভাবে বলতে পারবেন। তবে জনগণের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
তারপর ২০১৮ সালে ভোটের আগের দিন রাতে ভোটকেন্দ্র দখল করে সরকারি দলের পক্ষে ব্যালটে সিল মারার জোরালো অভিযোগ রয়েছে। এতে নিশ্চিতভাবেই গণতন্ত্র হয়েছে দুর্বল। তাই বলা যায়, ২০০৮ সালের পর একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন দেখতে পায়নি এ দেশের জনগণ। তারা সংগতভাবে আশা করছে, ২০২৪ সালের সূচনায় অনুষ্ঠেয় নির্বাচনটি অন্তত সেগুলোর মতো হবে না। এতে থাকবে ভোটারদের অংশগ্রহণের সুযোগ। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর অনমনীয় অবস্থানে থাকায় এরূপ লক্ষণ দৃশ্যমান নয়।
উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। তারপর সংযোজন করা হয় সংসদ চালু রাখার বিধানও। তবে এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের একটি বিভক্ত রায় তাদের জন্য সহায়ক হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবস্থিত একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ দ্বারা। তখন এর পক্ষে জোরালো অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ। সে ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল—এসব বলা যাবে না। তবে সুযোগ ছিল সেসব সংশোধনের।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তখন সংবিধানে এরূপ কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও তিন জোটের রূপরেখা অনুসারে দেশের কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে নিতে হয় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। তিনি সফলভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে নবনির্বাচিত সংসদ তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ ও কর্মকালকে বৈধতা দিয়ে সংবিধানে সংশোধনী আনে। তাহলে আমরা দেখছি, সাংবিধানিক ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও এ দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সফলভাবে চালু হয়েছিল ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে। এখন গোটা বিষয় অতীত হয়ে গেছে।
দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনগুলোয় বরাবরই বিরোধী দলের বর্জন কিংবা এ ধরনের কারণে ভোটারের উপস্থিতি নগণ্য হয়, এমনটাই লক্ষণীয় হয়েছে। বলতে হয়, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও এর পেছনে অবদান রাখে। তারা আন্তরিক হলে এমনটি ঘটার কথা ছিল না। এবারও বিএনপির নির্বাচনে আসার কিংবা সরকার কর্তৃক তাদের নিয়ে আসার জোর প্রচেষ্টা আছে—এমনও মনে হয় না। বিষয়টি রাজনৈতিক। তাই কমিশনও থাকছে নীরব। এ ক্ষেত্রে আমাদের হতাশ হওয়াই স্বাভাবিক।
তাহলে যাচ্ছি কোথায় আমরা? বর্তমান সরকার একটি দৃশ্যমান সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যত দিন পারে ক্ষমতায় থাকুক। এ বিষয়ে কারও ভিন্নমত নেই। ভারতে জওহরলাল নেহরু ক্ষমতায় ছিলেন আমৃত্যু প্রায় ১৭ বছর। সে দেশের পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট রাজ্য শাসন করেছে ৩৪ বছর।
আমাদের সংবিধানের প্রণেতারাও ভোটারদের অধিকার প্রয়োগের দিকে নজর রেখেছিলেন। সংবিধানের বিধান অনুসারে প্রজাতন্ত্রের মালিক এর জনগণ। আর এ দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে একাধিকবার উল্লেখ রয়েছে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভের পরও তদানীন্তন শাসক চক্র কেন্দ্র ও প্রদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে একটি বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার কথা। সে চেতনাকে ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু আজ বিভিন্ন সরকারের সময় বারবার গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। এখনো এমনটাই ঘটছে। রাজনীতিকেরা এ দেশের মানুষ। জনগণের নেতা। দেশকে তাঁরাও ভালোবাসেন।
তাঁরা চাইলে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন সামনে রেখে যে বিপত্তি এসেছে, তা দূর করতে পারেন। তবে উভয় পক্ষকে এতে আগ্রহী হতে হবে। এমনটাই চায় এ দেশের লোক। নির্বাচন কমিশনকে দেশের শাসনব্যবস্থার নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বিধানগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জোরালো নমুনা লক্ষণীয় হচ্ছে না। এমন না হলে ভোট প্রশ্নবিদ্ধই থাকবে। আমাদের গন্তব্য হবে অনিশ্চিতের দিকে।
● আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব