বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে কখনোই সুষ্ঠু হয়নি, তার প্রমাণ স্বাধীনতার পরের এ রকম সব নির্বাচন। তবে সবচেয়ে সমালোচিত একতরফা নির্বাচনের দৃষ্টান্ত হিসেবে সবার ওপরে যে বছরগুলো রাখতে হবে, সেগুলো হলো ১৯৮৬, ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি), ২০১৪ এবং ২০১৮।
এর সঙ্গে যোগ হতে যাচ্ছে ২০২৪! এই নির্বাচন যেভাবে হচ্ছে, তাতে বহুদিনের পরিকল্পনা, গবেষণা এবং আয়োজনের স্পর্শ পাওয়া যায়!
প্রায়ই সরকারের লোকজনের কথা শুনে আমাদের টাসকি লেগে যায়, ভাবি যে কীভাবে সম্ভব এই মাত্রার উল্টো কথা বলা? যেমন ‘আমরা ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছি’। কিন্তু সবাই তো জানে ২০০৮ সালে বিপুল ভোটাধিক্যে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আর কোনো সরকার আসেনি।
২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচন যথাক্রমে ‘একতরফা’ এবং ‘রাতে ভোট’ নামে ইতিহাসে চিহ্নিত থাকবে। দুই ক্ষেত্রেই জোরজুলুম বড় ভূমিকা রেখেছে।
কিংবা সরকার দাবি করে ‘দুর্নীতির প্রতি আমাদের জিরো টলারেন্স’, কিন্তু সবাই দেখছে দুর্নীতি বেড়েছে অভূতপূর্ব মাত্রায়। তাঁরা বলছেন যে ‘পরিবেশ নষ্ট করে কোনো প্রকল্প করা হবে না’, অথচ গত এক দশকে যে মাত্রায় নদী, জলাভূমি দখল, বন উজাড় ও পরিবেশদূষণ হয়েছে, এর কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই, ইত্যাদি।
তবে এসবের ভিড়ে ওবায়দুল কাদের কিছু সত্য কথা বলেছেন। যেমন তিনি বারবার বলে গেছেন ‘খেলা হবে’! খুবই ঠিক, পুরো একটা খেলার ছক যে ছিল, ক্রমে তা পরিষ্কার হয়েছে। আরেকটা কথা তিনি বলেছিলেন ‘তলেতলে’, আসলে ‘তলেতলে’ অনেক কিছুই হয়েছে।
প্রথম পর্বের খেলা ছিল বিএনপি সমাবেশ করলে আওয়ামী লীগ পাল্টা সমাবেশ করবে। ২৮ অক্টোবর এই শান্তিপূর্ণ পাল্টাপাল্টি সমাবেশ পর্ব শেষ হয়।
দ্বিতীয় পর্বের খেলা হচ্ছে, সহিংসতা সৃষ্টি করে একতরফা নির্বাচন। ধরপাকড়, দমন-পীড়ন প্রবল আকার নেয় এই পর্বে, বাড়ি বাড়ি মুখোশধারীদের আক্রমণ, খুনও হয়েছে। পুলিশ হেফাজতেও মৃত্যু, হাজার হাজার মামলা, রাতারাতি রায় সবই হয়েছে। সেই সঙ্গে বাসে আগুন, ট্রেনে আগুন—একদিকে দমন-পীড়ন, আরেক দিকে তার যৌক্তিকতা তৈরি করা।
এর সর্বশেষ বীভৎস প্রকাশ ট্রেনে আগুন দেওয়া, মা এবং তিন বছরের শিশুসহ চারজন খুন। বিএনপি বলছে সরকার করেছে, সরকার বলছে বিএনপি করেছে। কে করেছে, এটা জানা যেত যদি তদন্ত কমিটি ঠিকঠাকমতো কাজ করতে পারত তারপর। তার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
সরকারের ভাবসাব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, তাদের ইচ্ছা একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা। আপাতত সামনে তাদেরই কর্মময় নির্বাচনের ২০১৪ ও ২০১৮ মডেল আছে।
২০১৪ সালের মডেল হলো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুপস্থিতিতে একতরফা নির্বাচন। ওই বছর ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগ, ক্ষমতায় যেতে দরকার ছিল ১৫১ আসন।
২০১৮ সালের মডেল হলো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আসবে কিন্তু ভোটকেন্দ্র, নির্বাচন কমিশনসহ থাকবে সবকিছুই পূর্ণ দখলে, ব্যালট বাক্স ভরে যাবে আগের রাতে।
এ বছর দুটো মডেল নিয়েই সরকার প্রস্তুত ছিল মনে হয়। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি না আসায় ২০১৪ মডেলই এগোচ্ছে, তবে এবারেরটিতে কিছু যোগ করতে হচ্ছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনোযোগের কারণে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রয়োজন ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা, উৎসাহ তৈরি করা। সে জন্য কারা বিজয়ী তা পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিত থাকলেও প্রচার হচ্ছে গান হচ্ছে, পোস্টার ছাপানো হচ্ছে, অসংখ্য সভা-সমাবেশ হচ্ছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী ডামি প্রার্থীদের নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য মিডিয়াভর্তি খবর যাচ্ছে।
২০১৮ সালে ভোটারদের কেন্দ্রে না আসতে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, এবারও আসার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
রাষ্ট্র ও সমাজের বহু প্রতিষ্ঠান এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আদেশক্রমে কাজ করছে সবাই। উপরন্তু এই নির্বাচনের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছেন বিদ্বৎসমাজের এক বড় অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, চারুশিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনেকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন।
বিদ্বৎসমাজের কাজ তো সরকারের কথামতো চলা নয়, বিশ্বাস আর ভক্তি নিয়ে অন্ধ সমর্থন করা নয়; কিন্তু এই প্রতিষ্ঠিত লোকজন এতই সরকারনির্ভর যে তারা বর্তমান সরকারের সময়ে অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, ব্যাংক লুট, মূল্যবৃদ্ধি, রামপালসহ সুন্দরবনবিনাশী-প্রাণবিনাশী প্রকল্প, বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে হলে নির্যাতনের কারখানা, ইসলামপন্থীদের দাবি মেনে গোপনে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, জমি দখল, ত্রাস সৃষ্টি সরকারি দলের লোকজনদের ভূমিকা কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে রাজি নয়।
জ্ঞানবিজ্ঞানের লোকজনের কাছ থেকে কোনো সরকারের জন্য এ রকম একচেটিয়া সমর্থন পাওয়ার দৃষ্টান্ত দুনিয়াতেই বিরল। বাংলাদেশে এ রকম দেখেছি প্রায় ৫০ বছর আগে।
তখন আমি কলেজের ছাত্র, মনে আছে সেই দৃশ্য: লাইন ধরে লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা বাকশালের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। আহমদ শরীফ, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, শাহাদৎ চৌধুরীর মতো হাতে গোনা কয়জনকে দেখেছিলাম এর বাইরে।
কিন্তু ওই উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের কয়েক মাস পর থেকেই আর এই বিগলিত অবস্থায় দেখা যায়নি। তাঁদের অনেকে জিয়ার সঙ্গে, অনেকে এরশাদের সঙ্গে গেছেন।
এই ধারার পুনর্জন্ম হয়েছে ২০০৯-এর পর। এরপর যত দিন গেছে, তত এদের সংখ্যা বেড়েছে; ভক্তি–বন্দনাও বেড়েছে।
তবে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষকদের তুলনামূলকভাবে তরুণ অংশ শুধু নির্বাচন নয়; নির্বাচনের পাশাপাশি পুরো সমাজের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তুলে এ সময়ে সরব থেকেছে।
যাহোক, একের পর এক এভাবে নির্বাচন করে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে জবাবদিহির সব ব্যবস্থা ভেঙেচুরে, কী রকম ভয়াবহ বিপদের দিকে দেশকে নেওয়া হচ্ছে, তা বোঝা কি খুব কঠিন? আমি এই যাত্রাপথের পরিণতিতে কমপক্ষে দশটি বিপদের নিশ্চিত বিস্তার দেখতে পাচ্ছি। এগুলো হলো:
১. সর্বজন প্রতিষ্ঠান এবং স্বাধীন প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘ওপরের আদেশে’ চলা চরম আকার নেবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা পূর্ণরূপ নেবে। নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক—সবই এর অন্তর্ভুক্ত।
২. বাংলাদেশে এখন পাকিস্তানের ২২ পরিবার থেকেও অধিক সম্পদশালী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, বৈষম্য অনেক বেশি বেড়েছে। এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ব্যাংক ঋণখেলাপি, নদী-জমি দখল, অতি ব্যয়ের প্রকল্প ভাগীদার, অর্থকরী ও বিদ্যুৎ খাত খেয়ে ফেলার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। জবাবদিহি নেই, এ রকম ব্যবস্থাই তাদের রক্ষা করে। এই ব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় দুর্নীতি, সম্পদ পাচার ও বৈষম্য আরও বাড়বে।
৩. রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর দলীয়করণ এবং অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার ব্যবহার দেখছি আমরা। এর দাপট বৃদ্ধিতে বাড়বে নির্বিচার ধরপাকড়, নজরদারিসহ সর্বজনের নিরাপত্তাহীনতা।
৪. শিক্ষা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরুদণ্ডহীন, লোভী লোকেরা প্রশাসনে; শিক্ষকেরা নিশ্চুপ অনুসারী; হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের অসহায় আক্রান্ত অবস্থা জোরদার হবে।
৫. জবাবদিহির ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সড়ক, ডেঙ্গুসহ কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বাড়বে।
৬. জ্ঞানচর্চা আটকে যাবে সরকারি বয়ানের মধ্যে। প্রশ্ন, বিশ্লেষণ, বিতর্ক যা সজীব সমাজের বৈশিষ্ট্য তার ওপর আঘাত বাড়বে। অন্ধবিশ্বাস, স্তুতি বাড়বে। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জোরজুলুম ও ধর্মনির্ভরতা বাড়বে।
৭. পাহাড়ে–সমতলে শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি, ভাষাগত বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী লড়াই আরও বেশি বাধার মুখে পড়বে। শ্রমজীবী ও সংখ্যালঘু মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে।
৮. আইনি-বেআইনি পথে মতপ্রকাশ, সংবাদ প্রকাশ এখনই চাপের মুখে। সামনে শিল্প-সংস্কৃতিসহ সব প্রকাশমাধ্যমের ওপর স্বৈরতন্ত্রী চাপ বাড়বে।
৯. বিশ্বক্ষমতার ভারসাম্য এখন টালমাটাল অবস্থায়। এর মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া সবারই আধিপত্য বৃদ্ধির ছকে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ঐক্য ও সংঘাত দুটোতেই বাংলাদেশ অধিকতর চাপে থাকবে, এই ঝুঁকি বাড়বে।
১০. কমিশন ও ক্ষমতার জন্য জাতীয় স্বার্থবিরোধী গোপন–প্রকাশ্য চুক্তির সুযোগ বাড়বে।
এই পরিস্থিতির মানে হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঢোল বাজতে থাকবে, আর দেশ যেতে থাকবে এভাবে আরও উল্টো দিকে। এই সর্বনাশের জন্য সরকারের সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা এর সমর্থন করছেন, যাঁরা লোভে-লাভে তাল দিচ্ছেন, তাঁদের সবাইকে দায় নিতে হবে।
● আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক