হাসিনা পালানোর পরও কেন সাভারে পুলিশ এই হত্যাকাণ্ড চালাল

শেখ হাসিনার বিদায় ঘোষণা বা দেশ ছেড়ে পালানোর পর গত ৫ আগস্ট রাজধানী ঢাকার পাদদেশ সাভারে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল, তার একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে প্রথম আলো। ভিডিওটি দেখার পর সত্যি আমি চোখে পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমার বিশ্বাস, যাঁরাই আবদুল্লাহ আল হোসাইনের ওই প্রামাণ্যচিত্র দেখেছেন, তাঁদের হৃদয়ের আরও একটিবার রক্তক্ষরণ হবে।

চব্বিশের ওই সব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অনেক ভিডিও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে হয়তো আছে, তবে প্রথম আলোর ওই অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্র এই গণ-অভ্যুত্থানের একটি সমন্বিত দলিল হিসেবে থাকবে, যা আমাদের বারবার মনে করে দেবে সেই দিনের নির্মমতাকে। সাভারের ওই ঘটনার ভুক্তভোগী পরিবার কতটা বিচার পাবে, জানি না, তবে এসব হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ বিচার না হলে দেশে আইনশৃঙ্খলা বা আইন-আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।

আরও পড়ুন

স্টেট কমান্ড কিলিংগুলো অতীতেও দেশে হয়েছে। সেগুলোরও বিচার হয়নি। ফলে চব্বিশের অভ্যুত্থান–পরিবর্তী সময়ে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশা আমরা সবাই করছি। তবে যেভাবে ঢালাও মামলা হয়েছে, ন্যায়বিচারের অভিপ্রায়ে যেভাবে রাজনৈতিকীকরণ হচ্ছে, মামলা–বাণিজ্য হচ্ছে এবং তদন্ত ব্যবস্থার যে ধীরগতি, তাতে ন্যায়বিচার নিয়ে কিছুটা শঙ্কা অবশ্যই থেকে যাচ্ছে।

তবে শেখ হাসিনা চলে যাচ্ছে, এমন খবর যখন দেশের ভেতর ও বাইরের গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করছে, তখন সাভারে এমন হত্যাকাণ্ড সত্যি মেনে নেওয়া যায় না। পাশবিকতার সব স্তর ভেদ করে খুনের উন্মদনা আমাদের মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রামাণ্যচিত্রের তথ্যমতে, বিক্ষুব্ধ জনতার রোষ থেকে বাঁচতে পুলিশ সাধারণ জনগণের কাছে কয়েক দফা আত্মসমপর্ণের পরও বারবার গুলি ছুড়ে নিজেদের অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে, যা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

হ্যাঁ, এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, পুলিশ হয়তো নিজেদের নিরাপত্তার জন্য গুলি ছুড়েছে। রাষ্ট্রের জানমাল রক্ষার বিষয়টি হয়তো আলোচনায় আসবে। কিন্তু কেন তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল? সাধারণ মানুষ কি থানায় ঢুকে কোনো পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছিল? ঠিক কতজন পুলিশ সেখানে আহত হয়েছিল, কেউ বলতে পারেন?

প্রামাণ্যচিত্রের ভিডিওতে কোথাও আমরা দেখতে পাইনি যে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতা সংঘর্ষে জড়িয়েছে। বরং সংক্ষুব্ধ হয়েছে, যখন তাদের মিছিলযোদ্ধা মাটিতে লুটেয়ে পড়েছে। নিরস্ত্র জনতার ওপর আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এমন পাশবিক আক্রমণ আমাদের হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, পুলিশের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ গুলি ছুড়েছিল। তাহলে পুলিশ কেন প্রাণঘাতী বুলেট ছুড়েছে? রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল দিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা করা যেত না? নির্বিচারে গুলি করার নির্দেশ তারা সে সময় কোথা থেকে পেয়েছিল, তা জানি না। শেখ হাসিনার বিদায়ে ভেঙে পড়া পুলিশের কমান্ড কার্যকর কতটা ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগবে।

সারা দেশে সাধারণ মানুষজন যখন বিজয়োল্লাসে ব্যস্ত, তখন এমন একটি সময়ে সাভারে আন্দোলনকারীদের দমন করার তাগাদা নিষ্প্রয়োজনীয় ছিল। যে বা যারা ওই কর্মে জড়িয়ে পড়েছিল, তাদের ভেতর প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করেছিল কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। তবে তাদের হাতে ওয়ারলেস/ওয়াকি–টকি সক্রিয় থাকার পরও সম্মুখযুদ্ধে জনতার ওপর আক্রমণ সব ধরনের পাশবিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে।

প্রামাণ্যচিত্রের ভিডিওতে কোথাও আমরা দেখতে পাইনি যে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতা সংঘর্ষে জড়িয়েছে। বরং সংক্ষুব্ধ হয়েছে, যখন তাদের মিছিলযোদ্ধা মাটিতে লুটেয়ে পড়েছে। নিরস্ত্র জনতার ওপর আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এমন পাশবিক আক্রমণ আমাদের হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।

আরও পড়ুন

প্রথম আলোর এই প্রামাণ্যচিত্রে কয়েকটি ভবনের ওপর থেকে গুলি ছুড়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় উঠে আসে। কিন্তু সেখানে পুলিশ ছিল না। অথচ আন্দোলনকারীরা কিছু না বুঝে উঠতেই অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। আন্দোলন দমাতে এভাবে স্নাইপার দিয়ে গুলিয়ে চালানো হলো কেন? স্মাইপার দিয়ে আন্দোলন দমানোর মতো এতটা নৃশংস কেন হতে হলো আওয়ামী লীগ সরকারকে?

প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনেকটাই স্পষ্ট, প্রাণঘাতী বুলেট তাঁদের শরীরে বিঁধেছে। উঁচু স্থান থেকে টার্গেট করে হোক কিংবা সম্মুখসারি থেকে হোক, মানুষ মরেছে। স্কুলছাত্র মরেছে। পেশাজীবী মরেছেন কিংবা আহত হয়েছেন।

জুলাই-আগস্টজুড়ে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলো আজও আমাদের অশ্রুসিক্ত করে। এসব ভিডিও কিংবা ছবি আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ারও করতে পারি না। কারণ, অনেক শিশুই হয়তো সেগুলো দেখে ট্রমাটাইজড হয়ে যেতে পারে। এই ভয় থেকে বিরত থাকলেও জুলাই-আগস্টের রক্তস্নাত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। শুধু আমি নই, আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের সবার যদি সাইকোলজিক্যাল টেস্ট করা যায়, দেখা যাবে আমরা পোস্টট্রমাটাইজড সেশনে আছি। আমাদের চিন্তাশীলতা কমেছে, আমাদের কর্মদক্ষতাও কমেছে। এর থেকে কেউই বের হতে পারছি না।

আরও পড়ুন

অথচ এমন নির্বিচারে মানুষ মারার পরও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন দেখতে পাই না। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করে বেড়াচ্ছে। ক্ষমতার হাতবদল হলেও রাষ্ট্রের সেই আগ্রাসী চেহারার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। কিন্তু কেউই হতভাগ্য পরিবারের ক্ষতিকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না; প্রিয় সন্তান হারানো মা–বাবার মূর্ছা যাওয়া চেহারাটাকে লালন করতে পারে না। ফলে লাশের রাজনীতি বিদ্যামান। আগামীতেও এসবের কতটা পরিবর্তন হবে, তা নিয়ে শঙ্কা অবশ্যই থেকে যাচ্ছে।

পক্ষপাতহীনভাবে সাভারসহ যেসব স্থানে নির্বিচারে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার পরিশুদ্ধ তদন্ত হতে হবে। ৫ আগস্টের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের বিচারের আওতায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব হত্যাকাণ্ডের ব্যথা একই। স্বজনহারাদের আর্তনাদও একই। এটা নিয়ে কোনো রাজনীতি হবে না। লাশের বিচার নিয়ে ব্যবসা চলবে না। তদন্তের মাধ্যমে তুলে আনতে হবে, সেদিন সাভারে পুলিশ কেন এই রকম অমানবিক আচরণ করেছে, তা দেশবাসীকে জানাতেই হবে। জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। সেটা থেকে পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com