আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী তৎপরতা চলছে। রাজনৈতিক দলের ভেতরে ও বাইরে। যে রাজনৈতিক দলের নেতারা বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়ার জন্য প্রতিপক্ষের কঠোর সমালোচনা করছেন, তাঁরাই আবার বিদেশি দূতাবাসে গিয়ে নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। এ রাজনীতি কেবল স্ববিরোধী নয়, শঠতাপূর্ণও।
বাংলাদেশের নির্বাচন, বাংলাদেশের মানুষ ভোট দেবে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। তাহলে বিদেশিরা কেন কথা বলছেন? বলছেন একটা কারণে যে আমরা আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারি না। অর্থাৎ, বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগটি আমরাই করে দিয়েছি।
৫২ বছর আগে যে বাংলাদেশ সাম্য, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ওয়াদা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যে বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরে নির্মম গণহত্যার শিকার হয়েছে, সেই বাংলাদেশের মানুষ কেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন না? এর জন্য জনগণ দায়ী নন, দায়ী হলেন যাঁরা সেই ‘জনগণের প্রভু’ সেজে বসেছেন। স্বাধীনতার পর তিনটি দলই মূলত দেশ শাসন করেছে—আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। কখনো এককভাবে, কখনো সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে।
সে ক্ষেত্রে নির্বাচন নিয়ে যদি দেশে কোনো রাজনৈতিক সমস্যা থেকে থাকে, সে জন্য পূর্বাপর শাসকগোষ্ঠীই দায়ী। আমাদের জনগণ কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি, সেটি ১৯৫৪ বা ১৯৭০ সাল হোক কিংবা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ কিংবা ২০০৮ সাল হোক। যখনই তাঁরা অবাধে প্রতিনিধি বাছাই করার সুযোগ পেয়েছেন, সঠিক নেতৃত্বই বাছাই করেছেন। কিন্তু আমাদের পূর্বাপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘রাষ্ট্র মেরামত’ ও ‘জনগণের দিনবদলের’ কথা বলেছেন, সেসব রাখেননি। একবার ক্ষমতায় এলে সবাই সেটাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মনে করেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে। সে সময়ও ইসি বিএনপিকে আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তারা যায়নি। নির্বাচনের আগে দলীয় সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি যে আন্দোলন করছে, সেই দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করছি না। কিন্তু তারপরও আমরা মনে করি, ইসির আলোচনার প্রস্তাব তাদের গ্রহণ করা উচিত। আলোচনা মানে একমত হওয়া নয়, দ্বিমত করার জন্যও আলোচনা হতে পারে।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের কথা বলে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে জনগণকেই সবচেয়ে বেশি অবহেলা করেন। জনগণের চেয়ে তাঁদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে ‘দলের লোক’, ‘আপন লোক’।
নির্বাচন নিয়ে যখন এসব কথা বলছি, তখন ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিভিন্ন দলের মধ্যে নানা কিসিমের তৎপরতা লক্ষ করছি। রাজনৈতিক দলগুলো ঘন ঘন বিদেশি দূতদের ‘মধ্যাহ্ন’ কিংবা ‘নৈশভোজে’ মিলিত হচ্ছে। নিজ নিজ দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করছে। নির্বাচন নিয়ে যে কথা তঁারা বিদেশি দূতদের বলছেন, সেসব কথা দেশের জনগণকে বলছেন না।
বিএনপি বলেছে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না। আওয়ামী লীগ বলেছে, সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। তাহলে সমাধানটা কী? একটা সমাধান আমরা ২০১৩ সালে দেখেছি। একতরফা নির্বাচন। নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে মাত্র ১২টি দল অংশ নিয়েছিল। আরেকটি সমাধান, নির্বাচনই না হওয়া। যেমনটি আমরা ২০০৭ সালে দেখেছি। বিএনপি গায়ের জোরে নির্বাচন করতে গিয়ে পারেনি। এক–এগারোর অনাকাঙ্ক্ষিত সরকার ক্ষমতায় আসে এবং নির্বাচনটি দুই বছর পিছিয়ে যায়। ২০০৭ সালে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ ‘লগি–বইঠা’ দিয়ে বিএনপির একতরফা নির্বাচন ঠেকিয়ে দিয়েছিল। বিএনপি ২০১৪ সালে ‘জ্বালাও–পোড়াও’ করে ঠেকাতে পারেনি। এতে ২০১৪ সালের নির্বাচনটি ন্যায্যতা পায় না। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচনে যাবেন না বলে ঘোষণা দেওয়ার পর কীভাবে রওশনের নেতৃত্বে দল নির্বাচনে গিয়েছিল, তা–ও কারও অজানা নয়। চালাকি কিংবা জবরদস্তি দিয়ে গণতন্ত্র হয় না।
জনমনে এখন একটাই প্রশ্ন, ২০২৩–এর শেষে অথবা ২০২৪–এর শুরুতে যে নির্বাচনটি হওয়ার কথা, সেটি কেমন হবে? আমরা কি আবার একটি একতরফা নির্বাচন পেতে যাচ্ছি, না সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে? সব দলের অংশগ্রহণ মানে প্রতীক বরাদ্দ ও প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করে বিরোধী দলের প্রার্থীদের ‘গৃহবন্দী’ করে রাখা নয়। মানুষ যা সাদাচোখে দেখেছেন, সেটিকে সরকারি প্রচারযন্ত্র শতবার অস্বীকার করলেও মিথ্যা হয়ে যাবে না।
বিএনপির সাংগঠনিক সমস্যা আছে, যার বহিঃপ্রকাশ আমরা সম্প্রতি দলের ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদের বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম। জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্বের বিরোধ স্পষ্ট—নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, তত সেই বিরোধ বাড়বে। দলের এক পক্ষ বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চায়। অপর পক্ষ চায় সংসদে বিরোধী দলের শিরোপাটি ধরে রাখতে। তারা জানে, বিএনপি নির্বাচনে এলে তাদের সেই শিরোপা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিবাদে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এই দল।
কথায় বলে, অতীত কখনো পুরোনো হয় না। ২০১৮–এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ই এখন তাদের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই বিজয় সরকারের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবে, এটা দলের নেতারাও ভাবেননি। কিন্তু তাঁরা চেয়েছিলেন সম্মানজনক একটি অবস্থান। এ কথার অর্থ এই নয় যে ভোট না পেলেও বিএনপির প্রার্থীদের জিতিয়ে দিতে হবে। অন্তত বিএনপির প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার, ভোটারদের কাছে যাওয়ার, কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেওয়ার পরিবেশটি তৈরি করা উচিত ছিল।
নির্বাচন কমিশন ফের বিএনপিকে আলোচনার জন্য চিঠি দিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে লেখা এক চিঠিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আপনাদের নিজস্ব দলীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কৌশল বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনোরূপ মন্তব্য নেই। তবে নির্বাচন কমিশন আপনাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলেও মনে করে, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতাদের সঙ্গে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান উপলক্ষে আনুষ্ঠানিক না হলেও, অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও মতবিনিময় হতে পারে।’
বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে। সে সময়ও ইসি বিএনপিকে আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তারা যায়নি। নির্বাচনের আগে দলীয় সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি যে আন্দোলন করছে, সেই দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করছি না। কিন্তু তারপরও আমরা মনে করি, ইসির আলোচনার প্রস্তাব তাদের গ্রহণ করা উচিত। আলোচনা মানে একমত হওয়া নয়, দ্বিমত করার জন্যও আলোচনা হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০০৬ সালে বিরোধী দলের দাবি উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পরও আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁর সঙ্গে বসেছিলেন। কিন্তু তঁারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসেননি।
জনসভার স্থানের বিষয়ে বিএনপি যদি ডিএমপির সঙ্গে কথা বলতে পারে, ইসির সঙ্গে নয় কেন?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি