অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ নামের একটি নীতিমালা প্রকাশ করেছে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক, ভূনিরাপত্তা ও ভূজ্বালানির দিক থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। এ কারণেই সব বৃহৎ শক্তি ও অন্যান্য শক্তির দৃষ্টি এখন এ অঞ্চলের দিকে। এ কারণেই এবং এ উপলব্ধি থেকেই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি প্রণীত হয়েছিল।
আমরা যদি পেছনে ফিরে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিকে (আইপিএস) দেখতে চাই, তাহলে দেখতে পাব ২০০৬ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে তাঁর ভারত সফরকালে দেশটির পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতার সময় এ ধারণা প্রথম নিয়ে আসেন। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর একটা সমষ্টিগত অভিন্ন অঞ্চল হিসেবে দেখা যেতে পারে বলে শিনজো আবে তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। বিষয়টি উল্লেখ করার সময় তিনি মোগল যুবরাজ দারাশিকোর একটি বইয়ের উক্তি উদ্ধৃত করে ধারণাটি প্রকাশ করেন।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলনীতি বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে এবং এর মূল ভিত্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত নীতিমালা। বাংলাদেশ যে রূপরেখা প্রকাশ করেছে, বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত নীতিমালা ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত নীতিমালার সঙ্গে সেটার অনেক ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য আছে। তবে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখায় পর্যাপ্ত গভীরতা নেই।
এরপর ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির বিষয়টি উল্লেখ করেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবার তাদের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলনীতিতে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কথা উল্লেখ করে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশদ ও সম্পূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলনীতি প্রকাশ করে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সহযোগিতা বৃদ্ধি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা-সংক্রান্ত চারদেশীয় (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া) সংলাপকে (কোয়াড) শক্তিশালী করার উদ্যোগও নেয়।
বাংলাদেশ একটি ইন্দো-প্যাসিফিক রাষ্ট্র। এ অঞ্চলের রাষ্ট্র হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলের উদীয়মান বিভিন্ন কৌশল ও নীতির সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত থাকতে চায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা সেই কার্যক্রমেরই একটা অংশ।
এটা প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, যেটার মূলনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’, সেটার ওপর ভিত্তি করে। এ রূপরেখায় ১৫টি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যেগুলো প্রয়োজন এবং যেগুলোতে আমাদের সম্পৃক্ত থাকা দরকার, অর্থাৎ আমাদের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করার বিষয়ে অঙ্গীকার প্রকাশ করা হয়েছে।
এর ভেতরে প্রধান দু-একটি বিষয় হচ্ছে, এ সমুদ্র অঞ্চলে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা যাতে বজায় থাকে এবং বর্তমান কাঠামোটি যাতে আরও শক্তিশালী করা যায়, তার ওপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শান্তি রক্ষা, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে সহায়তা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। ভৌত, প্রাতিষ্ঠানিক, জ্বালানি অন্যান্য ক্ষেত্রে এবং জনগণের চলাচল সহজতর করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে যেসব বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ আছে, সেগুলোই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে আমরা জানি, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলনীতি বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে এবং এর মূল ভিত্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত নীতিমালা। বাংলাদেশ যে রূপরেখা প্রকাশ করেছে, বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত নীতিমালা ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত নীতিমালার সঙ্গে সেটার অনেক ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য আছে। তবে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখায় পর্যাপ্ত গভীরতা নেই।
প্রথমত, লক্ষ করা যায়, ইন্দো-প্যাসিফিক যে একটি কৌশলগত ভূরাজনৈতিক অঞ্চল, সেটার বিবরণ এখানে দেওয়া হয়নি। কাজেই ইন্দো-প্যাসিফিক বলতে আমরা কী বুঝি, সেটাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এ ছাড়া এ কৌশল রূপরেখার উদ্দেশ্যগুলো কী কী, সেগুলোও চিহ্নিত করা হয়নি। যেকোনো কৌশলনীতির একটা প্রধান দিক হলো তার বাস্তবায়ন পদ্ধতি বা পরিকল্পনা। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের পরিকল্পনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবেই সব কৌশলনীতিতে একটা কর্মপরিকল্পনা উল্লেখ করা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের রূপরেখায় সেটা বিদ্যমান নেই। ফলে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেটা সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় না।
প্রকাশিত রূপরেখায় কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার পাবে, সে ব্যাপারও উল্লেখ নেই। এখানে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সহযোগিতা করার কথা বলা থাকলেও এর বাইরে অন্য কোনো সহযোগিতার কথা বলা হয়নি। কিন্তু আমরা জানি, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলনীতির প্রধান একটি অঙ্গ হলো নিরাপত্তা সহযোগিতা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নীতিমালা কী হবে, সেটা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কোয়াডের ব্যাপারে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি কী, সেটারও উল্লেখ নেই। তবে মহাকাশে সহযোগিতার ব্যাপারে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাকাশে একটি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট ছাড়া বাংলাদেশের কোনো সক্ষমতা না থাকার ব্যাপারটি কেন উল্লেখ করা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়।
ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা প্রকাশের কারণে বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো ঝুঁকি তৈরি হওয়ার সুযোগ কম। কেননা, কোনো দেশ বা ব্লকের পক্ষে থাকা কিংবা বিপক্ষে দাঁড়ানোর কোনো বিষয় এখানে উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা প্রকাশ করেছে বলে অন্য কারও সঙ্গে সহযোগিতা করবে না, এমনটাও বলা হয়নি। খুব সাধারণ কিছু নীতি এ রূপরেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত যে নীতিমালা, সেখানে নিরাপত্তা সহযোগিতা, জোটের মতো গভীর বিষয়গুলো উল্লেখ করা আছে। বাংলাদেশের রূপরেখায় এ ধরনের কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে সদ্য প্রকাশিত ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। বিশেষ করে এ কারণে যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো ছাড়া এ অঞ্চলে বেশির ভাগ দেশই এখন পর্যন্ত ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিমালা প্রকাশ করেনি। এখন পর্যন্ত যে ২২টি দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলনীতি বা রূপরেখা প্রকাশ করেছে, তার ভেতরে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হলো। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তাচেতনা আরও গভীর ও সম্প্রসারিত হবে, যাতে বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লাভবান হতে পারে।
● মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান এনডিসি, পিএসসি (অব.)। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। ইমেইল: [email protected]