কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় গত জুনে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের খুনের ঘটনায় ভারতীয় যোগসাজশ থাকার কোনো তথ্য-প্রমাণ কানাডার সরকার এখনো হাজির করতে পারেনি; কিন্তু কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সম্প্রতি পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, এই গুপ্তহত্যার সঙ্গে ভারতীয় যোগসাজশ থাকার ‘সম্ভাব্য’ একটি বিশ্বাসযোগ্য ‘অভিযোগ’ তাঁরা পেয়েছেন।
গত বছর থেকে এ পর্যন্ত পুরোটা সময় ভারত বৈশ্বিক ভূরাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলন এর অন্যতম কারণ। জনসংখ্যার দিক থেকে ভারত চীনকে এবং জিডিপি অর্জনের দিক থেকে যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন দেশে গিয়ে ক্রমবর্ধমানভাবে লালগালিচা সংবর্ধনা পাচ্ছেন, সেখানে ওয়াশিংটনে তাঁর সফর বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
চীনের টালমাটাল আর্থিক খাতের সময়ে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি হবে বলে জোরালো পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বমঞ্চে অধিকতর দৃঢ় ভূমিকায় আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে দেশটি কি কোনো অন্ধকার জগতের দিকে পা বাড়াচ্ছে? এমনিতেই জি–২০ সম্মেলনে মোদির বক্তব্যে ইউক্রেন-যুদ্ধ ইস্যুতে দিল্লির অবস্থান নিয়ে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা উঠেছে।
কানাডার সঙ্গে ভারতের চলমান বিবাদে ভারতীয় কূটনীতির দুটি অতিরিক্ত দিক আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। প্রথমটি হলো, ভারত তার মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, এমন যেকোনো শক্তির প্রতি অধিকতর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো, কেউ সার্বভৌমত্ব নিয়ে আঘাত করলে ভারত প্রত্যাঘাত করতে পিছপা হবে না।
ইন্দো-কানাডিয়ান সম্পর্কের অবনতি প্রবাসে থাকা ১ কোটি ৮০ লাখ ভারতীয় নাগরিকের নেতিবাচক দিকটি সামনে আনছে। মোদি বিভিন্ন দেশে যখন সফরে যান, তখন তাঁকে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে বিপুল উৎসাহে স্বাগত জানানো হয়; কিন্তু সম্প্রতি খালিস্তানি শিখ নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারত-কানাডার টানাপোড়েনে অনেকের কাছে এই বার্তা যাচ্ছে যে ভারতের সরকারবিরোধী প্রবাসী ভারতীয়দের কারণেই ভারত ও অন্য দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মজার বিষয় হলো, এই দুটি পয়েন্টের সঙ্গেই চীনের সমান্তরাল যাত্রা জারি আছে। চীন ও ভারত উভয়েই তাদের ঐতিহাসিক বঞ্চনার প্রত্যুত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে। জাপান ও পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া চীনের ‘শত বছরের লাঞ্ছনা’র সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের কাছ থেকে ভারতের পাওয়া ‘দুই শ বছরের অবমাননা’র মিল রয়েছে।
চীনের মতো ভারতও তার প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে গিয়ে আর্থিক জবরদস্তির আশ্রয় নেওয়াকে বিবেচনায় রাখছে। এ ক্ষেত্রে তার ১৪০ কোটি মানুষের বাজারের প্রবেশাধিকারকে ভারত কাজে লাগাচ্ছে। কানাডা ও ভারতের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের জন্য ৯ বার সমঝোতা বৈঠক হয়েছে এবং শিগগিরই চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার কথা; কিন্তু সম্প্রতি কানাডা ও ভারত পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কার করার পর সেই চুক্তির সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
কানাডার শিখ নেতা হত্যায় ভারত সরকারের জড়িত থাকার অভিযোগ শেষ পর্যন্ত যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ক্রমবর্ধমান নির্লজ্জতাকে প্রকাশ করে দেবে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোতে, বিশেষ করে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী তৎপরতাকে নিশানা করে গোয়েন্দা ও সামরিক তৎপরতায় সক্রিয় আছে; কিন্তু শিখ নেতা হত্যায় ভারতের হাত থাকলে সেটি হবে পশ্চিমা দেশে ভারতের নজিরবিহীন রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট হত্যাকাণ্ড। এটি স্পষ্টতই একটি গেম চেঞ্জার হয়ে দাঁড়াবে।
সৌদি সরকারের সমালোচনাকারী নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে ইস্তাম্বুলে মার্কিন কনস্যুলেটে হত্যা করার পর সৌদি সরকারের সমালোচনায় বিশ্ব ফেটে পড়েছিল। একইভাবে রাশিয়ার পুতিন সরকারের সমালোচনা করায় সালিসবারিতে দুজনের ওপর রুশ গোয়েন্দাদের বিষপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছিল।
কানাডায় শিখ নেতা হত্যায় ভারতের যোগ থাকা প্রমাণিত হলে সেই ঘটনা ইস্তাম্বুল ও সালিসবারির কুখ্যাত ঘটনার কাতারে চলে যাবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে বেকায়দায় ফেলে দেবে। কারণ, তারা চীনের উত্থান ঠেকাতে ভারতের গণতান্ত্রিক অবনমন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে কখনোই ততটা আলোচনায় আনতে চায়নি; কিন্তু কানাডার মতো প্রধান মিত্র দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা এখন আর তারা উপেক্ষা করতে পারছে না।
সর্বশেষ কথা হলো, ইন্দো-কানাডিয়ান সম্পর্কের অবনতি প্রবাসে থাকা ১ কোটি ৮০ লাখ ভারতীয় নাগরিকের নেতিবাচক দিকটি সামনে আনছে। মোদি বিভিন্ন দেশে যখন সফরে যান, তখন তাঁকে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে বিপুল উৎসাহে স্বাগত জানানো হয়; কিন্তু সম্প্রতি খালিস্তানি শিখ নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারত-কানাডার টানাপোড়েনে অনেকের কাছে এই বার্তা যাচ্ছে যে ভারতের সরকারবিরোধী প্রবাসী ভারতীয়দের কারণেই ভারত ও অন্য দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, বিশ্বব্যাংকের প্রধান অজয় বঙ্গসহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত অনেক নেতা বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ২৬ জন সিইওসহ বহু লোক বহু পদে রয়েছেন। এই মানুষগুলো অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের সেতুবন্ধ তৈরি করতে পারেন।
আবার এই মানুষগুলোই অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিতে পারেন। এই প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা হলো, কানাডা ভারতের বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম শিখ জনসংখ্যার আবাসস্থল; কানাডায় বর্তমানে যে জোট সরকার ক্ষমতায় আছে, সেই জোটের একটি শরিক দলের নেতৃত্বে আছেন শিখ নেতা জগমিত সিং। স্বাভাবিকভাবেই ট্রুডোর সরকার শিখ গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তথা ভারতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের প্রতি সহানুভূতিশীল কি না, তা নিয়ে ভারতীয়দের মনে প্রশ্ন উঠছে।
এই অবস্থা ভারতের আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা বিবেচনায় রাখা দরকার। ভারত তার কূটনীতিতে ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ নিযুক্ত করেছে—এমনটা বলার মতো সময় হয়তো এখনো আসেনি। তবে এটি স্পষ্ট, ভারত-কানাডা সম্পর্কের অবনমন অধিকতর পেশিশক্তি প্রদর্শক ও আরও আক্রমণাত্মক ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির উত্থানের ইঙ্গিত দেয়।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● ড. চিতিজ বাজপেয়ী গবেষণা সংস্থা চ্যাথাম হাউসের সিনিয়র ফেলো