যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দশকের পর দশক ধরে চীন যে গুপ্তচরবৃত্তি করে আসছে, সেই সুবিশাল ক্ষেত্রের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ হলো সম্প্রতি খবরে উঠে আসা গোয়েন্দা বেলুন। দুঃখজনকভাবে সেই বেলুন-গোয়েন্দাবৃত্তি সফলও হচ্ছে।
আধুনিক যুগে অন্য দেশের গোপন তথ্য হাতিয়ে নিতে মনুষ্য ও প্রযুক্তির মিশ্রমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মে গোয়েন্দা অভিযান চালানো হয়। তবে চীন গুপ্তচরবৃত্তিতে আলাদা ধরনের পন্থা অবলম্বন করে থাকে।
চীনের ২০১৭ সালের জাতীয় গোয়েন্দা আইনে পরিষ্কারভাবে দেশটির সকল কোম্পানি ও নাগরিকদের গোয়েন্দা কাজে সহযোগিতা কাজে অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। ওই আইনে বলা হয়েছে:
‘আইনানুগভাবে জাতীয় গোয়েন্দা কাজে প্রত্যেক সংস্থা ও ব্যক্তিকে সহযোগিতা করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা তাকে বজায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা কাজে সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’
২০১৭ সালের আগেও চীনের কোনো বেসামরিক লোককে নিরাপত্তা সংস্থা ‘চায়ের দাওয়াত’ দিলে তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকত না, তারা তাকে কী বলতে চাইছে। সেই অবস্থা এখনো আছে।
প্রত্যেকটি চীনা কোম্পানি অথবা যে কোনো চীনা নাগরিক সরকারের গোয়েন্দাবৃত্তির গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম বলে বিবেচিত। এমনকি বিদেশে থাকা চীনা নাগরিকদেরও সহযোগিতা করতে চাপ দেওয়া হয়। কারণ সরকার জানে বিদেশে থাকা ওই চীনা নাগরিকদের দেশে পরিবার পরিজন কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কিছু আছে যার কারণে তাঁরা কথা শুনতে বাধ্য হবেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তৎপরতার ধরন একেবারে আলাদা। যেমন, আমেরিকান কর্তৃপক্ষ মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠান অ্যাপলকে দিয়ে গণহারে মানুষ হত্যা করা সন্ত্রাসীরও আইফোন আনলক করাতে পারেনি। অ্যাপল তা করতে কিছুতেই রাজি হয়নি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের টেলিকমিউনিকেশনস ও ইলেকট্রিক্যাল নেটওয়ার্কে ঢোকার জন্য চীন তার ভূ উপগ্রহ, ইলেকট্রনিক মাধ্যমের পাশাপাশি তাদের বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও ব্যবহার করে থাকে। আমেরিকান কোম্পানিগুলো তাদের সিস্টেমে সেগুলো প্রতিস্থাপন করতে সহায়তাও করে থাকে। কেন? কারণ চীনারা এটি নিশ্চিত করে যে তাদের প্রযুক্তি পণ্যগুলো দামে খুবই সস্তা; ফলে তাদের পক্ষে এসব পণ্যকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢোকা ঠেকানোর উপায় থাকে না। চীনাদের এই তৎপরতা শুধু যে ‘তথ্য শুষে নেওয়া’ পর্যায়ে আটকে থাকে, তা নয়; সেগুলোর কিছু কিছু অনেক সময় আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে স্বাধীনতা দিয়ে থাকে, বেইজিং অনেক সময় তারও সুযোগ নিয়ে থাকে। যেমন চলাচলের স্বাধীনতা, নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার স্বাধীনতা এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার সুবিধাকে চীন অনেক সময় তথ্য সংগ্রহের কাজে লাগিয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো এফবিআইয়ের পরিচালক ক্রিস্টোফার রে বলেছেন, তাঁরা প্রতি ১২ ঘণ্টায় একটি করে চীনের সম্পৃক্ততা আছে এমন একটি করে মামলা নথিভুক্ত করছেন। তবে সম্ভবত প্রতি একটির বিপরীতে একশটি ঘটনা হয়তো তাদের নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
চীন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার পেছনেই শুধু পড়ে নেই, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদকেও তাদের নিশানায় রেখেছে। বছরের পর বছর চীন এই কাজ করে যাচ্ছে।
চীনের সরকারের পাশাপাশি চীনা ব্যক্তিরা গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি চুরি করে তারা নিজেরাই নিজেদের কোম্পানি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে থাকে। চীনে স্থাপন করা আমেরিকান কোম্পানিগুলো চীনা গুপ্তচরদের এবং ‘ফ্রিল্যান্সার’দের জন্য সেই রাস্তা সহজ করে দিচ্ছে। সব সময়ই যে চীনা ব্যক্তিদের চীন সরকার দিক নির্দেশনা দিয়ে কাজ করাচ্ছে, তা নয়। তবে এই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া তথ্যকে সরকার পরে কাজে লাগাচ্ছে এবং চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও জাতীয় শক্তির ক্ষেত্রে তা বড় ভূমিকা রাখছে।
আমেরিকার সরকারের ভেতরে ও বাইরে থাকা লোকেরা বরাবরই চীনের গোয়েন্দা তৎপরতার হুমকি সম্পর্ক জানেন। সিআইএর প্রাক্তন কর্মকর্তা নিক এফটিমিয়াডেস ১৯৯০ এর দশকের আগের চীনা তৎপরতা নিয়ে বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি চীনের তৎপরতা নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হুঁশিয়ারি অনুযায়ী নিজেদের করণীয় সম্পর্কে আমেরিকানরা খুব কমই সচেতন হয়েছেন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে যে চীনা বেলুন দেখা গেছে তার প্রযুক্তি সন্দেহাতীতভাবে আমেরিকানদের কাছে পরিচিত, কারণ এই প্রযুক্তি তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থেকেই নিয়েছে।
এফবিআই নিয়মিতভাবে চীনা গুপ্তচর এবং তাদের আমেরিকান সহযোগীদের আইনের আওতায় আনে এবং সাজা দেওয়ার (যদি তাঁরা আমেরিকান হেফাজতে থাকে) ব্যবস্থা করে থাকে। কিন্তু এসব কিছু হয় শালীন ও নমনীয় ভঙ্গিমায়। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো তাদের প্রযুক্তিকে নিরাপদ রাখতে চায়, কিন্তু তারা চীনকে রাগাতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত ও গবেষণারত চীনা নাগরিকদের ধরপাকড় করার বিরুদ্ধে মার্কিন শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার থাকেন। চীন রেগে যাবে এমন যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ওয়ালস্ট্রিট প্রতিবাদ করে।
সবচেয়ে বড় কথা, চীনা গুপ্তচর যার বান্ধবী সেই ব্যক্তি যখন মার্কিন কংগ্রেসম্যান হন এবং হাউস ইন্টেলিজেন্স ওভারসাইট কমিটির সদস্য থাকেন, তখন বুঝতে হবে আমেরিকানরা তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আদৌ সিরিয়াস নয়।
চীনের এই গোয়েন্দাবৃত্তির বিষয়টি আমেরিকান প্রশাসন এক রকম উদাসীনই ছিল। ২০১৫ সালে যখন চীনা হ্যাকাররা ২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন নথি চুরি করল তখনো ওবামা প্রশাসন ‘চীন’ শব্দটি উচ্চারণ করতেও অস্বীকার করেছিল।
এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে চরবৃত্তির অভিযোগে হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীনা চরবৃত্তি বন্ধে বিচার মন্ত্রণালয়কে চাপ দেন। এটি বেইজিংয়ের ‘ঈশ্বরকে’ আতঙ্কে ফেলে দেয়। এরপর দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জো বাইডেন চীনের তৎপরতা বন্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করেন। এটিকে অনেক আমেরিকান বুদ্ধিজীবী বর্ণবাদী আচরণ বলে নিন্দা জানান।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি গোয়েন্দা তৎপরতা চালায় না? হ্যাঁ চালায়। তবে সেটি তারা করে প্রথাগত উপায়ে। মূলত ইলেকট্রনিক ও স্যাটেলাইট নজরদারির মাধ্যমে। পাশাপাশি কিছু গোয়েন্দা কর্মকর্তা আছেন যাঁরা চীনা নাগরিকদের তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তথ্য জোগাড় করে থাকেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা অতি সামান্য। সোজা কথা, যুক্তরাষ্ট্র ‘বাণিজ্যিক’ গুপ্তচরবৃত্তি করে না।
সবচেয়ে বড় কথা, চীনা গুপ্তচর যার বান্ধবী সেই ব্যক্তি যখন মার্কিন কংগ্রেসম্যান হন এবং হাউস ইন্টেলিজেন্স ওভারসাইট কমিটির সদস্য থাকেন, তখন বুঝতে হবে আমেরিকানরা তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আদৌ সিরিয়াস নয়।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনূদিত
গ্রান্ট নিউজহাম প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিক ও অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন মেরিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা।