সরকার ও জনগণের মাঝের প্রাচীরটি ভাঙবে কারা

১৫ আগস্ট রাত আটটা। একটি তেল কোম্পানির রংপুরের ব্যবস্থাপক আমাকে ফোন দিলেন। যিনি চিলমারীতেও বেশ কিছুদিন ডিপো ব্যবস্থাপক হিসেবে ছিলেন। যিনি কছিম উদ্দীন ভাওয়াইয়া উৎসব, পণ্ডিত বইমেলাসহ প্রতিটি কাজে সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন। এমনকি আগের সরকারের শাসনামলে অনেক সময় বিরোধী নেতা–কর্মীদেরও সহযোগিতা করেছেন। তিনি বললেন,  ‘বিপ্লবের ফল পেলাম।’
তাঁর কান্নাভেজা কণ্ঠে শুনতে পেলাম, সেদিন বিকেলে রংপুর মহানগর একটি বড় দলের সভাপতি তাঁকে গালিগালাজ করেছেন। আওয়ামী ট্যাগ দিয়েছেন।

ঘটনাটা পরদিন শুক্রবার সকালে একজন উপদেষ্টাকে জানালে তিনি বিস্মিত হন। বললেন, ‘তাঁরা এই হুমকি দিচ্ছেন কেন? তাঁরা তো ক্ষমতায় নেই।’ পরে তিনি জ্বালানিসচিবকে বিষয়টি জানাতে চাইলেন।

রংপুরের সেই ব্যবস্থাপক আমাকে তাঁর বদলি হওয়ার চিঠিটা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। সেখানে দেখা যায়, পেছনের তারিখ ১৫ আগস্ট উল্লেখ করেই তাঁকে বদলি করা হয়েছে।

২.

দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে দর্শনের বিভাগীয় প্রধান এনামুল হক, আমার কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক, কবি মাসুদুল হকসহ আমার বাড়িতে চলে এসেছেন। উদ্দেশ্য আওয়ামী হুইপ ইকবালুর রহিম কলেজ ক্যাম্পাসে ‘শেখ কামাল আইটি পার্ক’ করবেন, এটা ঠেকাতে হবে। প্রথম আলোয় কলাম লিখেছিলাম ‘দিনাজপুর কলেজ ক্যাম্পাসেই ঢোকাতে হবে আইটি সেন্টার’।

১৬ আগস্ট রাষ্ট্রচিন্তার অনুষ্ঠান শেষে মধ্যরাতে বাসায় ফিরতেই এনামুল স্যারের ফোন, ‘আমার ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকেরা নাকি লীগ, এই বলে বদলির হুমকি দিয়ে গেল।’

রাষ্ট্র ভূমিকা নেওয়ার আগে আওয়ামী লীগের বদলে যে পুরোনো শক্তি আছে, তারা গিয়ে সক্রিয় হচ্ছে এবং তা হচ্ছে অভ্যুত্থানের নামেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নওগাঁর একটি প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক তিনি ফোন করে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের লোকেরা তো সব জায়গা দখল করে আছে। বড়জোর সচিবের জায়গায় যুগ্ম সচিব বসছেন, তিনিও তো আওয়ামী লীগই। আগের জন যে দুর্নীতি করেছেন, তাঁর ভাগ তো ইনিও পেয়েছেন। সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা প্রতিষ্ঠানটি উদ্ধার পাবে কেমনে?’

৩.

ড. মুশতাক হুসাইন খান সমকালকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের যে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ছিল, তা ভেঙে গেছে। কারণ, নতুন একটা শক্তি রাস্তায় এসে গেছে। এখন এই চুরমার থেকে কী বেরিয়ে আসবে? আমরা যদি কিছুই না করি ও রাস্তার শক্তি যদি ছয় মাস পরে বাড়ি ফিরে যায়, তাহলে আগের শক্তি ফিরে আসবে। হয়তো একদম আগের অবস্থায় আমরা ফিরব না, কিন্তু কাছাকাছি জায়গায় যাব। এ ধরনের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ক্ষমতার বিন্যাস বদলায় না। ক্ষমতার বিন্যাস বদলায় তখন, যখন এমন কিছু নতুন সংস্থা বা সংগঠন তৈরি হবে, যারা নতুন নিয়মগুলো কার্যকর করবে।’

প্রশ্ন হচ্ছে, স্থায়ীভাবে ক্ষমতার বিন্যাস বদলাতে নতুন সংস্থা বা নতুন সংগঠন করবে কারা? উপদেষ্টারা প্রতিষ্ঠিত পুরোনো শক্তিকে সরিয়ে জনগণের ভেতরে কেমনে ঢুকবেন?

দেড় সপ্তাহ পুলিশ ছিল না, ট্রাফিক ছিল না। সমাজ এগিয়ে এসে পুলিশের অভাব পূরণ করেছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক সামলেছে।

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের কথা জানি। কমরেড নুর মোহাম্মদকে আহ্বায়ক ও কমোডর খুরশেদ আলমকে সদস্যসচিব করে সমুদ্রসম্পদ রক্ষা জাতীয় গড়ে ওঠে। ’৯৬ সালে সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পরিকল্পনা যখন করে, তখন জাতীয় কমিটির কমোডর খুরশেদ আলমকে সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়। যথারীতি বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারকে মামলায় হারিয়ে দেয়। এটা একটা নজির যে আন্দোলনকারীদের কাজে লাগানো।

বর্তমানের গণ-অভ্যুত্থানের সরকারকে তেমনিভাবে জ্বালানি আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে জ্বালানি কর্মকর্তা, রেল আন্দোলন থেকে রেলের, নদী-পরিবেশ-কৃষি-শিক্ষা আন্দোলন থেকে, ছাত্র-জনতার মধ্য থেকে একদল প্রতিনিধি খুঁজে বের করতে হবে। যারা সরকার ও জনগণের মাঝখানের আমলাতান্ত্রিক প্রাচীরটি ভেঙে দেবে।

১৯-২০ বছরের একটা ছেলের হাতে গুলি লেগে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে কবজি। পেটের চামড়া কেটে হাতে বসানো হয়েছে। এই ছেলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একজন ভাই যখন বললেন, ‘আপনাদের ত্যাগের কারণেই আজ আমাদের এই অর্জন’, তখন দেখলাম, ছেলেটি কেমন নিশ্চল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। আরেকজনকে দেখলাম হাঁটুর নিচের অংশে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সাত-আটটি গুলি করেছে পুলিশ। পায়ে গুলি লাগার অংশের পুরোটাই একেবারে থেঁতলে গিয়েছে। রাজমিস্ত্রির কাজ করা ছেলেটির মা আমাদের পায়ে ব্যান্ডেজ করার আগের ছবি দেখালেন, কী বীভৎস অবস্থা!

বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে আসার পর অনেকগুলো ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, কিন্তু এখনো স্বাভাবিক হতে পারছি না। বারবার ওই জীবন্মৃত লোকটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে—এ যাত্রায় বেঁচে ফিরলে যে লোকটা আর কখনোই কথা বলতে পারবে না, দুই চোখে কিছু দেখতেও পারবে না।

খোদা, ফরিয়াদ জানাই, এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতা যেন চিরস্থায়ী হয়, চিরজীবী হয়।

কথাগুলো একজন আন্দোলনকারী সহসমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র রিফাত রিদওয়ানের।

স্বাপ্নিক, লড়াকু ও গণ-আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্ব ছাড়া নতুন বাংলাদেশ জন্ম নেবে না। ইতিহাসে যেসব দেশে গণ-অভ্যুত্থান বা গণযুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল ঘটেছে, সেই সব দেশে বিপ্লবী শক্তিকে এটাই করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বেহাত হওয়ার পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে না দেওয়াটাই বড় কারণ। ৬৫০–এর বেশি শহীদ আর ৩৩ হাজারের বেশি আহতের বিনিময়ে ২৪–এর ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান, সরকার ও জনগণের মাঝের প্রাচীরটি ভাঙতে এবারও ব্যর্থ হবে?