সাপ্তাহিক ছুটির রাতে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ অন্য শহরগুলোয় ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্যবস্তু ছিল সামরিক স্থাপনা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বেসামরিক বসতি ও স্থাপনা। যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের বেসামরিক জনগণের ওপর এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সংগঠিত হামলা। এতে ১৯ জন নিহত হয়েছেন। তবে রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযোগকারী সেতুতে বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়ায় এ হামলা হয়েছে ভাবা ঠিক হবে না; রাশিয়া যে সামরিকচর্চা করে আসছে, এ হামলা তারই একটা চরম রূপ।
গত সপ্তাহেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর কুখ্যাত জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনকে ইউক্রেন যুদ্ধের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নৃশংসতা চালানোর জন্য সুরোভিকিন ‘প্রলয়ংকরী জেনারেল’ নামে পরিচিত।
কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তর–পূর্ব ইউক্রেন ও দক্ষিণ ইউক্রেনে রুশ বাহিনী ক্রমাগত পিছু হটতে থাকায় পুতিনের হাতে দুটি বিকল্পই বাকি ছিল। প্রথমটা হলো, ইউক্রেন আগ্রাসনের পরিকল্পনাটি ঠিকঠাক কি না, তা নিয়ে আরেকবার ভাবা। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, ইউক্রেনে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করা। সামরিক রসদ ও গোলাবারুদের ঘাটতি থাকার পরও দ্বিতীয় বিকল্পটাই বেছে নিয়েছেন পুতিন। বলা চলে, পুতিন সরাসরি ও কলঙ্কজনক পথটিই গ্রহণ করলেন। ইউক্রেনীয়দের বেসামাল করে দেওয়ার জন্য পুতিনের নতুন কমান্ডার ইউক্রেনের শহরগুলোর ওপর রকেট ছুড়েছেন।
ফেব্রুয়ারিতে আগ্রাসনের শুরুতে পুতিন দ্রুততম সময়ের মধ্যে জয়ের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা ব্যর্থ হয়েছে। ইউক্রেনে অধিকৃত ভূখণ্ড ধরে রাখতে না পারায় এ পর্যন্ত অন্তত ছয় শীর্ষ কমান্ডারকে সরিয়ে দিয়েছেন পুতিন। এপ্রিল মাসে শীর্ষ কমান্ডার আলেকজান্দার দভোরনিকভকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পরাজিত জেনারেলদের সরিয়ে দেওয়া শুরু করেন।
চেচনিয়া ও সিরিয়াতে দীর্ঘ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল দভোরনিকভের। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে তিনি ‘সিরিয়ার কসাই’ নামে পরিচিত। ইউক্রেন যুদ্ধে সেই দভোরনিকভও কার্যকর প্রমাণিত হননি। তাঁর পরিবর্তে গত জুন মাসের শেষে জেনেডি জিদকোকে কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তিনি রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সাবেক পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ও দেশটির উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী। কোনো এক রহস্যজনক কারণে তাঁকেও খুব শিগগির সরিয়ে দেওয়া হয়। ৭ অক্টোবর সুরোভিকিন নিয়োগ পাওয়ার আগপর্যন্ত সে তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি।
প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি ‘কসাই’ উপাধির জন্য যথার্থ হন, তাহলে সুরোভিকিনই হবেন সবচেয়ে যোগ্য নাম। মিখাইল গর্বাচেভকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ১৯৯১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রথম সুরোভিকিনের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় তিনি একটি সাঁজোয়া বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। তাঁর বাহিনী গর্বাচেভপন্থী তিন প্রতিবাদকারীকে হত্যা করেছিল। ছয় মাস কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্তি পান।
একুশ শতকের প্রথম দশকে চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে একটি সাঁজোয়া বিভাগেরও দায়িত্ব ছিলেন সুরোভিকিন। সে সময় তাঁর কমান্ডে পরিচালিত বাহিনীর নয়জন সেনা দেয়াল ধসে নিহত হন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, একজন মাতাল সেনা গ্রেনেড কিংবা স্থলমাইন দিয়ে দেয়ালটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ঘটনার জন্য সুরোভিকিন চেচনিয়ার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দায়ী করেন। প্রতিশোধ হিসেবে একজন রুশ সেনার বিপরীতে তিনজন চেচেনকে হত্যা করা হয়েছিল। ধীরে ধীরে চেচেন বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে সেক্যুলার বিদ্রোহীদের, পরে ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠীকে।
দ্বিতীয় দশকে সুরোভিকিন সিরিয়ায় তাঁর নৃশংসতার স্বাক্ষর রাখেন। বিদ্রোহীদের গুঁড়িয়ে দিতে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাসার আল–আসাদকে সহায়তা করে রাশিয়া। বিমানবাহিনীতে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সুরোভিকিনকে সিরিয়ার বিদ্রোহী–অধ্যুষিত শহরগুলোয় ব্যাপক বোমা হামলা পরিচালনার নেতৃত্ব দেওয়া হয়। ইরানের বাহিনী ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ স্থল অভিযানের ক্ষেত্রে আসাদকে সহযোগিতা করে।
এখন ইউক্রেনে ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটছে। এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার রিজার্ভ বাহিনীকে পুনর্গঠিত করার জন্য ইউক্রেনের ওপর পাল্টাহামলা চালানো প্রয়োজন পুতিনের। ইউক্রেনকে দখল করতে গেলে ইউক্রেনকেই ধ্বংস করে ফেলতে হবে পুতিনকে।
সম্মিলিত এ অভিযান আসাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে। ২০২০ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, রাশিয়ার বাহিনীর হামলার কৌশল ছিল বেসামরিক স্থাপনা ও অবকাঠামোর ওপর হামলা চালানো। সুরোভিকিনের কমান্ডে রুশ বাহিনীর হামলাগুলো হয়েছে সিরিয়ার বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার ও বেসমারিক অবস্থানকে লক্ষ্য করে।
এখন ইউক্রেনে ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটছে। এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার রিজার্ভ বাহিনীকে পুনর্গঠিত করার জন্য ইউক্রেনের ওপর পাল্টাহামলা চালানো প্রয়োজন পুতিনের। ইউক্রেনকে দখল করতে গেলে ইউক্রেনকেই ধ্বংস করে ফেলতে হবে পুতিনকে।
সুরোভিকিনই এ কাজে পুতিনের সবচেয়ে যোগ্য সহচর।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ডেনিয়েল উইলিয়ামস দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সাবেক বিদেশ প্রতিনিধি