দেশে এখন গরম ইস্যু তিনটি। তিনটা তিন অঙ্গনে। রাজনীতিতে, ক্রীড়া আর বিনোদনে। সংবাদমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবার রীতিমতো ঘুম হারাম হয়ে গেছে। দেশের একেবারে নিম্নপর্যায়ের নাগরিক থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্ত এর কোনো না কোনোটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন। তবে দেশে আরেকটা বিষয় চরমভাবে বিরাজমান এবং সেটি নিয়েই হতে পারত সবচেয়ে বেশি আলোচনা। অন্য কোনো দেশ হলে সেটিই ঘটত।
সামনে নির্বাচন। দেশি-বিদেশি কত ধরনের তৎপরতা বা নাড়াচাড়া চলছে। ভোটের অধিকার এবং দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য মানুষ মুখিয়েও আছে। এইসবের মধ্যে এখন রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচনা গণ অধিকার পরিষদকে ঘিরে। দেশের রাজনীতিতে তারুণ্যনির্ভর ও নবীন এ দল পথচলার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। ইসরায়েলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদি নামে আলোচিত এক ব্যক্তির সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুরের দেখা করা, তা নিয়ে স্বীকার-অস্বীকার, সেই সঙ্গে নুরের বিরুদ্ধে নানা সময়ে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে দলটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। গোটা দেশের মানুষের মুখে মুখে গণ অধিকার পরিষদের ভেতরে এ অস্থিরতা এখন ‘হট টপিক’।
আর বিনোদনে ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পাওয়া দুই সিনেমা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিশ্বাস ফেলাই কঠিন হয়ে পড়েছে। শাকিব খান আর আফরান নিশো—দুজনেরই তুমুল জনপ্রিয়তা। বিশাল ফ্যান বেজ। কার সিনেমা কয়টি হলে মুক্তি পেয়েছে, কোন সিনেমা বেশি ব্যবসা করছে, কোন সিনেমার টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, কোন সিনেমা ‘চক্রান্ত’ করে কোন হলে চলতে দেওয়া হচ্ছে না, কোন সিনেমাকে বেশি সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে, কে নায়ক আর কে নায়ক না, সিনেমার হিরো আর নাটকের অভিনেতা, কোনটি সিনেমা আর কোনটি সিনেমাই হয়নি—এ রকম অসংখ্য বিষয় নিয়ে এ দুই সিনেমার দর্শকেরা এক সপ্তাহ ধরে বিভক্ত। এমনকি সিনেমা হলের সামনে ব্যানার নিয়ে অবস্থান কর্মসূচিও হয়েছে। এটিও বলতে হয় যে বহুদিন পর ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ঘিরে দর্শকদের এমন উন্মাদনা জোরেশোরেই প্রকাশ পেল দেশে। একদিক থেকে এটি বেশ সুখকরই বিষয়।
সর্বশেষ ‘ঘুম হারাম’ করা ইস্যু এখন তামিম ইকবাল খান। দেশের ক্রিকেট অঙ্গনের অন্যতম তারকার অবসর নিয়ে টানা দুই দিন চরম নাটকীয়তা দেখল মানুষ। কোনো সন্দেহ নেই, দেশের ক্রিকেটকে বেশি কিছুই দিয়েছেন তামিম। একটা সময় যে বাংলাদেশ দলের সবাই মিলে ১০০ রান পার করতে পারত না, সেখানে তামিমরাই একাই সেটি করতেন। তামিমের সেঞ্চুরি দেখতে দেখতে একটা প্রজন্মের বড় হওয়া।
স্বাভাবিকভাবেই অবসরের ঘোষণায় তামিমের কান্নাভেজা চোখ লাখো তরুণকে অশ্রুসিক্ত করেছে। অনেকেই তাঁর এই ঘোষণা মানতে পারছিলেন না। অবশেষে নানা জল্পনাকল্পনা শেষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তামিম তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। আগামী এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে তিনি থাকছেন। লাখো ভক্তের মুখে ফুটেছে হাসি।
কিন্তু যে বিষয়টি এই সব ইস্যুকে ছাপিয়ে যেতে পারত, সেটি হলো ডেঙ্গু। যখন শাকিব, নিশো, নুর, তামিমকে নিয়ে একের পর এক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের ঢেউ উঠছে, তখন আমরা ডেঙ্গুতে একের পর এক শিশুর মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। প্রথম আলোর প্রতিবেদন—ডেঙ্গুতে ভিকারুননিসা ছাত্রীর মৃত্যু: ‘মেয়েটা তো সময়ই দিল না, হুট করেই চলে গেল’, ‘ছেলেটা মঙ্গলবারও হাসপাতালে হাসল, খেলল আর এখন তার জানাজা হবে’, ‘মেয়ের সৎকার শেষে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে।’
ঈদ করতে টাঙ্গাইল থেকে মা-বাবার সঙ্গে ঢাকার মহাখালীতে নানির বাসায় এসেছিল আট বছরের শিশু আহনাফ রাফান। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তার এই আনন্দভ্রমণ ভরে ওঠে কষ্টে। এক সপ্তাহ পর সন্তানের লাশ নিয়ে গ্রামে ফিরতে হলো আহনাফের মা-বাবাকে। বাবা মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটা মঙ্গলবারও হাসপাতালে হাসল, খেলল আর এখন তার জানাজা হবে। বাড়ি ফেরার জন্য ছেলে চিৎকার–চেঁচামেচি করল। বাড়ি ফিরেছে, তবে...।’ এরপর হয়তো ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা ও নোংরা পরিবেশ নিয়ে যে ক্ষোভ করলেন, তা তো আসলে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার আজীবনেরই লজ্জা।
আহা, শ্রাবন্তী নামের বাচ্চা মেয়েটা। নাম শুনলেই মনে হয় কোনো এক প্রজাপতি, এদিক–সেদিক হেসেখেলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ঈদের ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা যাবে, তা নিয়ে ছিল কত উচ্ছ্বাস। ঘুরতে যাওয়ার আগে মেয়েটার জ্বর উঠেছিল, দুই দিনে কিছুটা কমেও আসে। কিন্তু কয়েক দিন পর আবারও সেই জ্বর ফিরে আসে, ঘোরাঘুরির মাঝপথেই তাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসে পরিবার। মাত্র ছয় দিনের ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেল পঞ্চম শ্রেণির মেয়েটা। তাকে শ্মশানে দাহ করেই তার ভাইকে নিয়েও ছুটতে হয় মা-বাবাকে। কারণ তাঁদের সেই সন্তানও ছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত। মেয়ের জন্য একটু শোক করবেন, সেই উপায়ও ছিল না। এই ঘটনা চট্টগ্রাম শহরের।
আরও শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ব্যথায়-যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডেঙ্গু এখন বর্ষা মৌসুম আর ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। একসময় ‘ঢাকা ফিভার’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ জ্বর এখন সারা বছর ধরে নিজের শক্তি জারি রেখেছে এবং গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমাদের সরকার, স্বাস্থ্য কর্ণধার ও সিটি করপোরেশনের মেয়ররা তখনই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন, যখন ডেঙ্গুতে একের পর এক মানুষ মারা যেতে থাকে। কেন এই প্রস্তুতি আরও আগে থেকে হয় না। কারণ, এখানে কোনো বিশেষজ্ঞ বা গবেষকের কোনো পরামর্শ বা সতর্কবাণীকে তাঁরা গুরুত্ব দেন না, যেটিকে সহজ বাংলা বলে ‘পাত্তা’ দেন না।
২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কৃষ্ণমূর্তি এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারকে একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। সেটি তখনো আমলে নেওয়া হয়নি, এখনো নেওয়া হচ্ছে না। ফলে এর দুই বছর পর ২০১৯ সালে বড় একটি ধাক্কা দেখতে হয়েছিল আমাদের। তবে সেটি ছিল অনেকটা ঢাকাকেন্দ্রিক। গত বছর এবং চলতি বছরের ডেঙ্গুর ছোবল সেই ধাক্কাকেই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, তবে সেটি আর ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
এখন যখন হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীতে ভরে যাচ্ছে, তখন ঢাকার এক মেয়র তাঁর জনতুষ্টিমূলক দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। আর আরেকজন মেয়র বলছেন, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় এখন পর্যন্ত আমরা ভালো অবস্থানে রয়েছি; যদিও আমাদের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ মৃত্যুর সংখ্যাই যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে আমরা কীভাবে অন্য দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছি, সেটি আমার মতো অনেকেরই বুঝে আসে না। করোনাকালেও সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের এমন বাগাড়ম্বর বক্তব্য আমরা শুনেছিলাম। এত বড় একটা মহামারি গেল, সেটি থেকে আমাদের কোনো কিছুই শিক্ষা নেওয়া হলো না। এই মহামারি পৃথিবীতে কত কিছু পাল্টে দিয়েছে। আর আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও তার কর্নধার বা নীতিনির্ধারকদের মধ্যে গেড়ে বসেছে আরও বেশি স্থবিরতা।
এ বছরের শুরুতে মশকনিধন বিষয়ে তালিম নিতে বিদেশ সফরে মানে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে গিয়েছিলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেখান থেকে বলেছিলেন, ‘আমরা এত দিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা তো ধ্বংস হয়নি। বরং অর্থের অপচয় হয়েছে।’ সঠিক পদ্ধতিতে মশা নিধনে দ্রুত কী কী যেন পদক্ষেপ নেবেনও বলেছিলেন। এরপর এ সম্পর্কে আমরা আর কিছু জানি না। সেই ভুল পদ্ধতিতেই তিনি ফিরে গেছেন বা সবকিছু সেভাবেই চলছে, এতটুকু আমরা জানি। আমরা এ–ও জানতে পারি, মশকনিধনের জন্য কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হলেও তাঁরা ছুটিই কাটান।
রাষ্ট্রের, সরকারের এবং জনগণের এই মুহূর্তে সবচেয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল ডেঙ্গুর প্রকোপের প্রতি। সরকার তো তার অবহেলা বারবার প্রকাশ করছে। আমরা নাগরিক হিসেবে এতটাই শক্তিহীন বা অধিকারহীন হয়ে পড়েছি যে সরকারকেও আমরা বাধ্য করতে পারছি না, বলতে পারছি না—ডেঙ্গুর হাত থেকে আমাদের সন্তানদের বাঁচান। হায়, একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কতটা অসহায়!
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী