মূল্যস্ফীতির কশাঘাত আরও অনেক দিন বয়ে বেড়াতে হবে। শিগগিরই এ চাপ থেকে মুক্তির কোনো আশা নেই। নেই সহজে স্বস্তি পাওয়ারও কোনো উপায়; বরং মূল্যস্ফীতিকে মেনে নিয়ে এ ভেবে সান্ত্বনা পেতে হবে যে দুনিয়াজুড়েই কম-বেশি মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত।
প্রায় মাস দেড়েক আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১-২২ অর্থবছরের যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে মূল্যস্ফীতির গতিপথ সম্পর্কে অনেকটা এ রকম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির অব্যাহত ঝুঁকি যে অদূর ভবিষ্যতে বহাল থাকবে, তা-ও স্পষ্ট করা হয়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার এক দিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। তাতে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় ও ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০২১-২২ অর্থবছরের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক ও খাত সম্পর্কে পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে, যাতে ব্যাংক তথা আর্থিক খাত বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এর পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনীতি সম্পর্কে কিছু পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। আর এ পূর্বাভাস দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করেছে। শব্দচয়ন থেকে বাক্যবিন্যাস এমনভাবে করা হয়েছে, যেন সরাসরি কোনো বার্তা প্রকাশিত না হয়!
দুনিয়াজুড়েই সামষ্টিক অর্থনীতি, বিশেষত মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আলোচনা-অভিমত-পূর্বাভাস—সবই কিছুটা সংযতভাবে প্রকাশ করা হয়। এর মূল কারণ হলো, আর্থিক বাজারে যেন কোনো ভুল বা বিভ্রান্তিকর বার্তা না যায় এবং বন্ড, শেয়ার ও মুদ্রার কেনাবেচায় কোনো অস্বাভাবিক দরপতন বা দরবৃদ্ধি যেন না ঘটে।
পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তেমন একটা স্বাধীনতা ভোগ করে না, বরং অর্থ মন্ত্রণালয় তথা সরকারের আনুগত্য করার চাপে থাকে, সেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনেক রাখঢাক করে কথা বলতে হয়। অবস্থাটা অনেক সময় এমন দাঁড়ায় যে শঙ্কার কথা খুলে বলাও যাচ্ছে না, আবার একেবারে না বললে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অবস্থান এবং মর্যাদাও ঠিক থাকছে না।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার বাজারদর ক্রমাগত বেড়ে চলার কারণে জনজীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছে, তা সবারই জানা। বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশের আগামী দিনের মূল্যস্ফীতির সার্বিক অবস্থার সঙ্গে চারটি বিষয় জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো—চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যহীনতা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, টাকা-ডলার বিনিময় হারের অস্থিরতা এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবধানী পূর্বাভাস তাই যতটা না আর্থিক বাজারের সংবেদনশীলতার প্রতি লক্ষ রেখে, তার চেয়ে অনেক বেশি সরকারের মনোভাবের দিকে খেয়াল করে দেওয়া। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবেদনের পূর্বাভাস অংশটুকু থেকে আসন্ন দিনে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির বিষয়ে যা বোঝা গেছে, তা খুব অস্পষ্টও নয়। চলতি অর্থবছরের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে, তা এ রকম: দেশের অর্থনীতি কোভিড-উত্তর পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে যাবে।
একই সময়ে বিশ্ববাজারের পণ্য ও জ্বালানির উচ্চ মূল্য প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক ছায়া ফেলবে। দীর্ঘায়িত রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা ও বিপর্যয়ের মূল কারণ, যা থেকে বাংলাদেশেরও নিস্তার নেই। এ কারণে এ বছর প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে।
প্রবৃদ্ধির হার কমার জন্য অবশ্য অভ্যন্তরীণ কিছু উপাদানের কথাও উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলো হলো—উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যায় শস্য, গবাদিপশু, মাছ ও অবকাঠামোর ক্ষতি হওয়া এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি ও জ্বালানির দাম বাড়ায় উৎপাদন ও আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়া।পাশাপাশি পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়া প্রবৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক হয়েছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর সঙ্গে দেশের বাকি অংশের জন্য একটি নতুন অর্থনৈতিক দ্বার উন্মোচন করেছে।
ইতিমধ্যেই ওই সব জেলায়ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে চাঞ্চল্য এসেছে যে সেতুতে রেল সংযোগ চালু হওয়ার পর আরও বাড়বে। এ ছাড়া সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেসব উদ্দীপনামূলক কর্মসূচি নিয়েছে, সেগুলোর সাফল্যজনক বাস্তবায়ন প্রবৃদ্ধিকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে।
প্রবৃদ্ধির হার যে অনেক কমে যাবে, তেমনটা অবশ্য মনে করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ১০। এ বছরের জন্য প্রথমে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এখন তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। মানে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। একই সঙ্গে উচ্চহারের মূল্যস্ফীতি দেখা দেওয়ায় দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রকৃত আয়ও আগের তুলনায় কমে যাবে।
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির বার্ষিক গড় হার ৫ দশমিক ৬০-এর মধ্যে আটকে রাখার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু দেখা গেল, বছরের শুরু থেকেই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে। জুলাই মাসে যেখানে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২২, জানুয়ারি মাসে তা ৭ দশমিক ৯২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এ বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতির হার বছর শেষে সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি যেন না হয়, সেটাই চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কাজটি যে বেশ কঠিন হবে, বার্ষিক প্রতিবেদনে সেটাও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বলা দরকার যে মাসওয়ারী মূল্যস্ফীতির হার আগস্টে রেকর্ড ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ হয়েছিল। এর পর থেকে কিছুটা নিম্নমুখী ধারায় থাকলেও জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতি মাসেই সাড়ে ৮ শতাংশের ওপরে আছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার বাজারদর ক্রমাগত বেড়ে চলার কারণে জনজীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছে, তা সবারই জানা। বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশের আগামী দিনের মূল্যস্ফীতির সার্বিক অবস্থার সঙ্গে চারটি বিষয় জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো—চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যহীনতা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, টাকা-ডলার বিনিময় হারের অস্থিরতা এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
আর তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির সঙ্গে মিলিয়ে রাজস্ব নীতি পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার লড়াইটা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।
আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক ও লেখক
[email protected]