ইস্যু আদতে টিস্যুর মতো। এক টানে একটা টিস্যু বের করো; ঠিকই পয়েন্টমতো আরেকটা এসে দাঁড়াবে। তবে কিনা টিস্যু এক সময় শেষ হলেও ইস্যু ফিনিশ হওয়ার জিনিস না। ‘রাজা যায় রাজা আসে’র মতো ‘ইস্যু যায় ইস্যু আসে’।
বেশির ভাগ ইস্যু আটচল্লিশ ঘণ্টার বেশি আয়ু পায় না। ছলেবলে-কৌশলে একটার তলে আরেক ইস্যু চাপা দেওয়া হয়। কিন্তু নায়িকা মাহিয়া মাহির নাটকীয় গ্রেপ্তারের পরও ‘আরাভ খান’ ইস্যু যেভাবে মাঠ দখলে রেখেছে, তাতে মনে হচ্ছে, এই ইস্যু আরও দিন কয়েক ‘ফুটেজ খাবে’।
এখন পর্যন্ত সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, আরাভ খানের (ওরফে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিক) মতো চুনোপুঁটিকে হাইব্রিড রাঘব বোয়াল করা সফল খামারিটা আসলে কে? কেউ বলছেন, অমুক; কেউ বলছেন, তমুক। কেউ বলছেন, আরাভ খান মনে হয় টিকটিকি থেকে টাকার কুমির হয়ে খামারিকেই খেয়ে দিয়েছেন। কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড কোটিপতির কেয়ারটেকার হিসেবে ঢুকে নিজেই শেয়ারহোল্ডার হয়ে এখন আর তাঁকে ফেয়ারলি কেয়ার করছেন না। কেউ বলছেন, হতেই পারে না; অত বড় ক্ষমতাধরদের ‘বাই বাই টাটা’ বলার মতো বুকের পাটা এখনো তাঁর হয়নি; সে এখনও ‘কাজের ছেলে’ই আছে।
আরাভ খানের প্রেমের টানে যাঁরা দুবাই গিয়েছিলেন, ইতিমধ্যে তাঁরাও পিঠটান দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার নাম ঘুরে ফিরে আসায় তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, আরাভ খান নামের কারও সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক পরিচয়ও কোনো দিন ছিল না। আরাভ জুয়েলার্সের ঝাঁপ খোলা অনুষ্ঠানে দাওয়াত খেয়ে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেওয়া একজন বলেছেন, ‘আমরা আরাভ খানকে খুঁজে বের করতে সহযোগিতা করেছি।’
গত সাত আট বছরে আরাভ খান যে মেধার খেলা দেখিয়েছেন, তাতে তাঁকে এত কাঁচা বুদ্ধির লোক মনে করতে মনে সায় দেয় না। যদি ধরে নিই আরাভের এই সোনার ব্যবসার পেছনে মহা প্রতাপশালী কেউ আছেন, তাহলে সেই লোক আরাভকে এভাবে প্রচার চালাতে দিলেন কোন কারণে? তাহলে কি এ ক্ষেত্রে ‘পাপে ছাড়ে না বাপেরেও’ বিষয়ক ঘটনা ঘটে থাকতে পারে?
এদিকে, ফেসবুকে একটি ফোনালাপের অডিও দেশে দেশে ভেসে বেড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে, ফোনের একপ্রান্তে আরাভ খান ও অপর প্রান্তে জুলকারনাইন সায়ের খান নামের একজন সাংবাদিক ছিলেন। ফোনে তাঁদের বিরাট ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে।
একপর্যায়ে আরাভ খান জুলকারনাইনকে বলেছেন, তাঁর পেছনে যে ব্যক্তিরা আছেন, তাঁদের দিয়ে তিনি তাঁকে (জুলকারনাইনকে) ভিডিও কল করাবেন। ভিডিওকলে সেই লোকদের চেহারা দেখলে জুলকারনাইনের ‘পা ধরে’ মাফ না চেয়ে আর উপায় থাকবে না। তাতে অবশ্য জুলকারনাইনকে ভয় পেতে ‘শোনা’ গেল না। তিনি উল্টো হুমকি দিলেন, ছয় মাসের মধ্যে আরাভ খানকে তিনি পথে নামিয়ে ছাড়বেন। আরাভকে পথে নামানো বিষয়ক প্রকল্পের কাজ সম্ভবত তিনি শুরু করেও দিয়েছেন এবং নিজের ফেসবুক পাতায় আরাভ খানের পিস্তল ধরা ছবি ও বিভিন্ন মামলা সংক্রান্ত কাগজপত্র ফাঁস করা শুরু করেছেন।
এই গরম ইস্যুর মধ্যে যে আরেকটি ঠান্ডা প্রশ্ন মানুষের মনের ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা হলো: যে লোকের ঘাড়ে পুলিশ কর্মকর্তা খুনের মামলা ঝুলছে; যে লোক হুলিয়া মাথায় নিয়ে দুবাইয়ে পালিয়ে ছিলেন; সেই লোকের এইভাবে ইলেকশনে নামা নেতার মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে সোনার দোকানের ঝাঁপ খোলা অনুষ্ঠান করতে হলো কেন? তিনি কি আন্দাজ করতে পারেননি যে, এতে তাঁর খুনখারাবির রেকর্ড বের হয়ে আসতে পারে?
গত সাত আট বছরে আরাভ খান যে মেধার খেলা দেখিয়েছেন, তাতে তাঁকে এত কাঁচা বুদ্ধির লোক মনে করতে মনে সায় দেয় না। যদি ধরে নিই আরাভের এই সোনার ব্যবসার পেছনে মহা প্রতাপশালী কেউ আছেন, তাহলে সেই লোক আরাভকে এভাবে প্রচার চালাতে দিলেন কোন কারণে?
তাহলে কি এ ক্ষেত্রে ‘পাপে ছাড়ে না বাপেরেও’ বিষয়ক ঘটনা ঘটে থাকতে পারে? মানে, দুবাই তো এমনিতেই গরম এলাকা, তার সঙ্গে পয়সার গরম যোগ হয়ে দেখা গেল আরাভ খানের মাথা এবং পেট গরম হয়ে গেছে। পেট গরম হওয়ার পর কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলার মতো মাথা গরম হওয়ায় তিনিও পরিস্থিতি ল্যাজেগোবরে করে ফেলেছেন।
তবে পরিস্থিতি আরাভ খানের আয়ত্তে থাকুক আর না থাকুক, এই ইস্যুতে আরও নতুন নতুন খবর যে বের হতে থাকবে তা প্রায় নিশ্চিত। আর কেঁচোর মতো সেই নতুন নতুন তথ্যের সঙ্গে ছোবল মারা কেউটে গোছের কিছু বের হয় কিনা, সেই আশায় অথবা আশঙ্কায় আরাভ ইস্যু নামক গর্তটার দিকে সারা দেশ চেয়ে আছে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]