২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করেন, তখন থেকেই দেশের আইসিটি তথা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বড় রকমের একটি বিপ্লব আমরা দেখতে পাই। ২০০৮ সালে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে যেখানে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ছিল ২৬ মিলিয়ন ডলার, সেটি ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৮ সালের মাত্র ৫০ হাজারের আশপাশে কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া এই ইন্ডাস্ট্রি এখন কর্মসংস্থান দিচ্ছে প্রায় ২০ লাখ মানুষের।
কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করে, এই বিপ্লবের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কোনটি ছিল? নিঃসন্দেহে বলা যায়, এককথায় সবাই উত্তর দেবেন, ‘সরকারের পলিসি সাপোর্ট’। সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ওপর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি সুবিধা দিল, সফটওয়্যারের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট মওকুফ করা হলো আর দেশীয় সফটওয়্যারের রক্ষার জন্য বিদেশি সফটওয়্যারের ওপর কর আরোপ করা হলো প্রায় ৫৮ শতাংশ।
অন্যদিকে নীতিমালা করা হলো, সরকারের সব সফটওয়্যার ক্রয় করতে হবে বেসিস (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস) সদস্যদের কাছ থেকে; অর্থাৎ সফটওয়্যার কিনতে হবে দেশের কোম্পানি থেকে। এই পলিসির সুবিধাও কিন্তু দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত হাতেনাতেই পেল, আর সেই সঙ্গে লাভবান বলো এই দেশ আর দেশের মানুষ।
২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী আমাদের সামনে আরেকটি ভিশন তুলে ধরলেন। সেটি হলো ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। স্বভাবতই এবার দেশের আইসিটি খাতের ওপর দায়িত্ব এসে পড়ল আরও বেশি। কারণ, স্মার্ট বাংলাদেশে দেশের এমন কোনো খাত নেই, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির দরকার হবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি থেকে শুরু করে যোগাযোগব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থাপনা, লজিস্টিক, কর ব্যবস্থাপনা, অত্যাধুনিক ট্রাফিক সিস্টেম—কোথায় থাকবে না প্রযুক্তির ব্যবহার।
কিন্তু সম্প্রতি একটি সংবাদ দেশের এই খাত সংশ্লিষ্ট সবার মনে একটি ভয়াবহ আশঙ্কা তৈরি করেছে। খবর বেরিয়েছে, সরকার নাকি ২০২৪-এর জুনের পর থেকে এই কর অব্যাহতি সুবিধা আর রাখবে না। আইসিটি-সংশ্লিষ্ট ২৭টি সার্ভিসের ওপর থেকে এই কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নিচ্ছে। এর বড় কারণ নাকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ। আর তার সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতিবছরের রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা তো আছেই।
একটি শিশু যখন বেড়ে ওঠে, তখন তার চারপাশের পরিবেশেরও সহযোগিতার দরকার হয়। সন্তানটি আস্তে আস্তে শৈশব থেকে কৈশোরে পৌঁছায়, কৈশোর থেকে পরিণত হয় যৌবনে। আমাদের আইসিটি খাত এখন শৈশব ছেড়ে কৈশোরে এসে পৌঁছেছে। যৌবনে পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হবে এখনো অনেক পথ। তার প্রমাণ আমরা পাই, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে ভারতের রপ্তানি ১৯৮ বিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের ৩০ বিলিয়ন, ফিলিপাইনের ১৮ বিলিয়ন, পাকিস্তানের ৩ বিলিয়ন আর ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের আশপাশেই আমরা এখনো আছি।
সন্দেহ নেই, সম্ভাবনা অনেক। ২০২৭ সাল নাগাদ এই খাত থেকে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৫ বিলিয়ন ডলার আর ২০৪১ সাল নাগাদ ৫০ বিলিয়ন ডলার। গত ৩-৪ বছরে এই খাত থেকে রপ্তানি প্রত্যাশিত গতিতে যেমন বাড়েনি এটি যেমন সত্য, তেমনি এর পেছনে রয়েছে যৌক্তিক কারণও। ২০২০ থেকে শুরু হলো কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ, আর মহামারি শেষে যখন এই খাত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, তখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে শুরু হলো রাশিয়ান-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়া বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। কিন্তু এই খাত থেকে রপ্তানি আয়ের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, সেটি হয়তো কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না।
সম্প্রতি একটি গবেষণা থেকে বেরিয়েছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এই খাতে দক্ষ লোকের ঘাটতি আছে প্রায় ৩০ লাখ, ইউরোপে রয়েছে প্রায় ২৫ লাখ, যুক্তরাজ্যে রয়েছে ১০ লাখ আর জাপানে রয়েছে ৫ লাখ। এই ঘাটতির ১ শতাংশ যদি দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে পূরণ করা যায়, তাহলে ২০৪১ কেন, এর অনেক আগেই ৫০ বিলিয়ন ডলার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
সেই সঙ্গে রয়েছে আফ্রিকা থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে সফটওয়্যার রপ্তানির অপার সম্ভাবনা, যে দেশগুলো মাত্র তাদের ডিজিটালাইজেশনের কাজ আরম্ভ করেছে। আরেকটি বিষয় বলে রাখা ভালো, আইসিটি সার্ভিস রপ্তানিতে ভ্যালু এডিশন ১০০ শতাংশ। এর অর্থ হলো, পোশাক খাত থেকে এখন যেমন ৫৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি রপ্তানি হলেও একটি বড় খরচ হয় কাঁচামাল আর মেশিনারিজ আমদানিতে, কোনো ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি করলেও তার চিপসগুলো আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। কিন্তু সফটওয়্যার-শিল্পে কোনো কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজন নেই, দেশের মেধা দিয়ে, দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়েই তৈরি হচ্ছে এসব সফটওয়্যার।
আরেকটি বিষয় হয়তো সবাই জানেন, যেকোনো শিল্প বিকশিত হওয়ার পেছনে প্রয়োজন হয় ব্যাংক ঋণের অথবা যেকোনো মাধ্যমেই হোক, ‘একসেস টু ফাইন্যান্স’-এর সুবিধা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অপার সম্ভাবনাময় এই খাত ব্যাংক ঋণের সুবিধা পায় না বললেই চলে। কারণ, ঋণের সুবিধার জন্য যে বাড়ি-জমি-ফ্যাক্টরি বন্ধক রাখার প্রয়োজন হয়, সেটি এই খাতের নেই। এখানে ১০০ শতাংশ কাঁচামাল হচ্ছে মেধা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, খাতটি এত দিন টিকে আছে কীভাবে? বিস্ময়কর হলেও সত্য, তারা টিকে আছে নিজেদের টাকায়। কষ্ট করে উপার্জন করার পর লাভের যে টাকাটি অবশিষ্ট থাকে, সেটি তারা বিনিয়োগ করে কোম্পানির কলেবর বৃদ্ধির জন্য অথবা নতুন নতুন প্রোডাক্ট তৈরির জন্য।
এখন আসলেই শঙ্কা থেকে যাচ্ছে, কর অব্যাহতি সুবিধা যদি আসলেই তুলে ফেলা হয়, তাহলে এই বিনিয়োগের টাকা কোথা থেকে আসবে? কর দিতেই তো লাভের অধিকাংশ টাকা শেষ হয়ে যাবে। আর স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য এখন বেশি প্রয়োজন বিদেশি বিনিয়োগ। বিদেশি অনেক কোম্পানি কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোতে বিগত বছরগুলোতে বিনিয়োগ করেছে এই ট্যাক্স হলিডে থাকার সুবাদে। যদি এখন এই ট্যাক্স হলিডে সুবিধা না থাকে সহজেই বলা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ আর তেমন একটি আসবে না। আর সেটি না হলে বিষয়টি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে বড় অন্তরায়।
শেষ করব ছেলেবেলার সোনার ডিম পাড়া হাঁসের একটি গল্প দিয়ে, যেটি মোটামুটি সবারই জানা। চাষি ও চাষির স্ত্রী প্রতিদিন সোনার ডিম বিক্রি করে ভালোই দিন চালাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন তাদের মনে হলো, হাঁসের পেট কেটে সব কটি ডিম একসঙ্গে বের করলেই তো রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়া যাবে। এরপর হাঁসটিকে মেরে ফেলার পর তারা হাঁস আর হাঁসের ডিম সবই হারাল।
আমাদের আইসিটি সেক্টরের অবস্থাও এখন সেই সোনার ডিমপাড়া হাঁসের মতো। প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হচ্ছে। হয়তো একসময় এটি দেশের অন্যতম বড় শিল্পে পরিণত হয়ে সরকারকে বিপুল রাজস্ব দেবে। কিন্তু এখনই যদি সরকার এই শিল্পের ওপর কর আরোপ করে বসে, তাহলে এই শিল্পের পরিণতি হবে সেই হাঁসের মতোই।
আরেকটি বিষয় বলে রাখা ভালো, বর্তমান সরকারকে দেশের জনগণ ২০০৮ সালে ভোট দিয়েছিলেন তাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের জন্য আর ২০২৪ সালে দিয়েছেন স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনের জন্য। সরকার এখন এই স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির প্রধান হাতিয়ার দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেবে, নাকি সম্ভাবনাময় খাতটির এখানেই অপমৃত্যু হবে, সেই সিদ্ধান্ত সরকারকেই নিতে হবে।
রাশাদ কবির পরিচালক বেসিস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ড্রিম৭১ বাংলাদেশ লিমিটেড।