শিরোনাম দেখে অনেকের নিশ্চয়ই আশির দশকের একটি বোম্বে সিনেমার গানের কথা মনে পড়ছে। বিএনপির কাছে নির্বাচন কমিশনের চিঠি পাঠানো নিয়ে যে ‘হাস্যরস’ তৈরি হয়েছে, তাতে সেই গানটির কথাই আচমকা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় শুনতাম বড়রা গুনগুন করে গাইতেন।
ম্যায়নে পেয়ার কিয়া—নায়ক সালমান খানের শুরুর দিকের ক্যারিয়ারের সিনেমা। সেটিরই একটি গান বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মানুষের মুখে মুখে বাজত। বাজবেই না কেন। তখন তো ছিল চিঠির যুগ। সে সময় প্রেম মানে তো লুকিয়ে চিঠি লেখা আর নানা কসরত বা কৌশল করে প্রিয় মানুষের কাছে পাঠানো। এই সিনেমাতেও চিঠি লিখে নায়িকা ভাগ্যশ্রী তাঁর পোষা কবুতরের কাছে বলছেন, সেই চিঠি যাতে সালমানের কাছে দিয়ে আসে—কবুতর যা যা যা, পেহলি পেয়ার ক্যা পেহলি চিঠি, সাজন কো দেয়া।
ডাকপিয়ন বা ডাক হরকরার আগের কালে, ঘোড়ার ডাকেরও আগের কালে...শত শত বা হাজারও বছর আগে মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানোর যাত্রা তো শুরু হয় কবুতর দিয়েই। সে সময় সেনাবাহিনীর যোগাযোগের মাধ্যমও ছিল এই কবুতর। চেঙ্গিস খান তো ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপজুড়ে কবুতরের পোস্ট অফিস গড়ে তুলেছিলেন রীতিমতো। একটা কবুতর ঘণ্টায় ৮০-৯০ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। এক দিনে হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে যেতে পারে। এমনকি ছয় হাজার ফুট উচ্চতাতেও উড়তে পারে। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই কবুতরকে পত্রবাহক বা বার্তাবাহক হিসেবে বেছে নেওয়া হতো এবং প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো তাদের।
আমাদের ইসি চাইলেও কিন্তু এমন কিছু কবুতর পুষতে পারে। সেগুলোকেও প্রশিক্ষণও দিতে পারে। কেন বললাম সে কথা? জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত সংলাপে বসতে চায় ইসি। এ জন্য সব নিবন্ধিত দলগুলোর কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে তারা। বিএনপির কাছেও চিঠি নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার একজন বার্তাবাহককে দলটির কার্যালয় নয়াপল্টনে পাঠায় ইসি। এখন বিএনপির কার্যালয় তো তালাবদ্ধ। বার্তাবাহক সেই চিঠি কাকে দেন, বিএনপির কোনো নেতার হাতে যে দেবেন, তেমন কাউকে পান না। বেচারা কয়েক ঘণ্টা ঘুরঘুর করেন সেই চিঠি নিয়ে। একপর্যায়ে তালাবদ্ধ ওই কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ভেতরে থাকা একটি চেয়ারের ওপর চিঠিটি রেখে এসেছেন তিনি।
চিঠির খামে প্রেরক হিসেবে লেখা আছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন আর প্রাপক হিসেবে মহাসচিব-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটির কার্যালয়ের তালাবদ্ধ কলাপসিবল গেটের সামনে ইসির বার্তাবাহকের ছবিও আমরা দেখলাম। কিন্তু সেই চিঠি যে প্রাপকের হাতে পৌঁছেছে, সেটির জন্য তো কারও প্রাপ্তিস্বীকার লাগে। চিঠি-ডাকপিয়নের যুগে এমনকি এখনকার কুরিয়ার সার্ভিসের কালেও সেটি আমাদের জানা কথা। এখন প্রাপ্তিস্বীকার না হোক, অন্তত কারও সাক্ষী তো অন্তত লাগবে। যেখানে কার্যালয়েই তালাবদ্ধ, কোথাও কেউ নেই, সেখানে নাকি বিএনপির কাছে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার সাক্ষী হিসেবে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে পথচারীকে। বার্তাবাহকের সঙ্গে সেই পথচারীর ছবিসহ নামধাম, গ্রামের ঠিকানাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে।
অনেকে এখন প্রশ্ন করতে পারেন, ইসি আসলে কোন দুনিয়ায় থাকে? ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়ে যা ঘটল, যে কায়দায় সমাবেশটি পণ্ড হলো এবং এর পর যা ঘটতে শুরু করেছে তা কি তাদের জানার বাইরে? আচ্ছা তা না হয় জানল, এরপর যে পরদিন ভোরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আটক করে সারা দিন ডিবি কার্যালয়ে বসিয়ে রেখে গ্রেপ্তার দেখানো হলো, তা তো তাদের না জানার কথা না। তাহলে সেই মহাসচিবের কাছেই কী করে চিঠি পাঠায় ইসি। আর যে ঠিকানায় পাঠাল, মানে বিএনপির কার্যালয় কবেই তালা মেরে দিয়েছে পুলিশ। ইসি তাহলে সেই চিঠি কারাগারে পাঠালেই ভালো হতো না? তাহলে প্রাপক মির্জা ফখরুলও চিঠিটি সরাসরি হাতে হাতে পেতেন।
ইসি হয়তো ভাবতে পারে মির্জা ফখরুল যেহেতু নেই, বিএনপির অন্য কারও শীর্ষ নেতার কারও হাতে দিলেই চলবে। কিন্তু বিষয়টি তো আর ‘চলাচলির’ বিষয় না। তেমনটিও যদি তারা ভেবে থাকে, তালাবদ্ধ কার্যালয়ে বিএনপি অন্য নেতারা কী করে থাকেন! এর মধ্যে বিএনপির শীর্ষ থেকে মধ্যম সারির নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে সরকার।
২৮ অক্টোবর সংঘর্ষকে ঘিরে নানা অভিযোগে। সেই সংঘর্ষ তো বিএনপির কর্মীরা নিজেরা নিজেরা করেননি। প্রতিপক্ষ তো কেউ না কেউ ছিল। তাহলে সংঘর্ষের দায় তাহলে শুধু এক পক্ষের কী করে হয়। এর দায় যে শুধু বিএনপির না, তা তো জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার সংস্থার বিবৃতিতে আমরা দেখলাম। গত এক যুগে সংবাদমাধ্যম আর বাক্স্বাধীনতার যা হাল করে ফেলা হয়েছে, দেশের রাজনীতির বিষয়-আশয় জানতে তো এখন বাইরের দিকেই আমাদের তাকিয়ে থাকতে হয়।
২৮ অক্টোবর শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করতে না পেরে কঠোর কর্মসূচিতে গেল বিএনপি। দীর্ঘদিন পর আবারও হরতাল ও অবরোধ দেখতে হলো দেশকে, দেশের মানুষকে।
বিএনপি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কঠোর আন্দোলনের দিকে না গিয়ে তাঁদের উপায় ছিল না। সরকারই তাঁদের সে পথে ঠেলে দিয়েছে। আর এক দেড় বছর ধরে যেভাবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তাঁরা গোটা দেশে একের পর এক শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ-মহাসমাবেশ করে আসছিলেন, তাতেও কিছু হচ্ছে না। বিদেশি চাপের মধ্যেও সরকারের যা মনোভাব, এ রকম হাজার কর্মসূচি করেও তাতে কিছু হবে না।
তার মানে সরকার কি এখন একতরফা নির্বাচনের দিকেই যাচ্ছে? আবারও ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন দেখবে কি না বাংলাদেশ—এমন প্রশ্ন গত এক বছর ধরে নানা মহলে যাঁকেই জিজ্ঞাসা করেছি, সাক্ষাৎকার নিয়েছি, অনেকে লিখেছেনও, তাঁদের সবারই মত ছিল, আগের দুইবারের মতো নির্বাচন করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু সব অসম্ভবকে সম্ভব করার পণ নিয়েই যেন এগোচ্ছে সরকার।
নির্বাচন কমিশন ‘এই করছে সেই করছে’, বিশিষ্টজনকে কতবার ডেকেও নিয়ে গেল তারা। বিশিষ্টজনেরাও গণতন্ত্র সুরক্ষা ও অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে হালকা-পাতলা-ভারী বক্তব্য দিয়ে হালকা-পাতলা-ভারী খাবার খেয়ে চলে এলেন। কত ভাবেই না ইসি বুঝিয়ে যাচ্ছে, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক—এমন ‘গালভরা বুলির’ নির্বাচন নিয়ে তারা বদ্ধপরিকর! সেই লক্ষ্যে এক ইসির বক্তব্য ছিল এমন—নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করার জন্য নতুন করে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কাউকে গ্রেপ্তার করলে হস্তক্ষেপ করবে নির্বাচন কমিশন।
এখন সরকারের খেয়াল বোঝা তো বড় মুশকিল। ইসি যখন একটা কথা বলেই ফেলল, তাহলে আর কী করা! নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সবাইকে জেলে ভরো। নির্বাচন করতে যে সবাইকে লাগে না, সেই নজির তো আছেই! এখন বিএনপির কেউ গেল জেলে, কেউ গেল পালিয়ে। যা-ই হোক, সরকারের কাজ সরকারে করছে, ইসির কাজ করবে ইসি।
হরতাল, অবরোধ যত কিছু ঘটুক, চিঠি পাঠানো তো আর আটকে থাকে না। দেশ ডিজিটাল হলেও, দুনিয়ার অতিগুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও বৈদ্যুতিক বার্তায় পাঠানো গেলেও বার্তাবাহকের হাত দিয়ে কাউকে চিঠি পাঠানোর ঐতিহ্যও কিন্তু এর মাধ্যমে ধরে রাখল ইসি। তবে তালাবদ্ধ বিএনপির কার্যালয়ে সেই চিঠি গ্রহণ করার যখন কাউকে পাওয়া গেল না, তখন ইসি চাইলে আরও একটি ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারত। কবুতরের মাধ্যমে সেই চিঠি পাঠিয়ে দিতে পারত আত্মগোপনে চলে যাওয়া বিএনপির কোনো নেতার কাছে। তখন বার্তাবাহক গাইতেন—কবুতর যা যা যা...ইসির চিঠি বিএনপির কাছে নিয়ে যা!
ইসির কাছে পরামর্শ থাকবে, আপনারা কিছু কবুতর পোষেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিন। তাহলে চিঠি পাঠানো নিয়ে এমন ‘তামাশা’ আমাদের আর দেখতে হবে না।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী