সংবিধান কেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বাধা হতে যাবে!

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বছরখানেকের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু এই নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে কি না এবং নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে কি না, সেই সংশয় এখনো কাটেনি। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে মূল বিরোধ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে। ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ। দলটির পক্ষ থেকে সংবিধান ‘রক্ষার’ হাঁকডাক দেওয়া হচ্ছে। অপর দিকে বিএনপির দাবি, সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচনে যাবে না বলে এরই মধ্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংবিধানই এখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রধান বাধা বা অন্তরায়।

‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ থাকবে কি না, সেটি একটি রাজনৈতিক বিষয় হলেও ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার সেই ব্যবস্থায় আর কোনো নির্বাচন করার সুযোগ না রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর ফলে সংবিধানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি ফিরে আসে।

দলীয় সরকারের অধীনে গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে বহু রকম সমালোচনা রয়েছে। ২০১৪ সালে বিএনপিকে ছাড়া ‘একতরফা’ এবং ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোটে’ নির্বাচন হয়েছে।

আরও পড়ুন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে, সেটা নিয়ে আশঙ্কা তাই অমূলক নয়।  আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত শুক্রবার (৬ জানুয়ারি, ২০২৩) জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ভাষণে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই আশ্বাসে কারও আস্থা নেই বলে বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা আমরা কেন এ দেশের জনসাধারণের কেউ বিশ্বাস করে না’ (প্রথম আলো, ৮ জানুয়ারি ২০২৩)।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তাদের পূর্বসূরিদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্নতর হবে, এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না, বরং নির্বাচন কমিশনের সদস্য কারও কারও কথায় মনে হচ্ছে তাঁরা সরকারের প্রতি অনেক বেশি ‘আস্থাশীল’।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা গ্রহণযোগ্যও হয়।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটনাটা ভিন্ন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা নির্বাচন কমিশনের। আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকার কথা। কিন্তু দলীয় সরকার থাকলে নির্বাচন কমিশন সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে কি না কিংবা চায় কি না, গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তাদের পূর্বসূরিদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্নতর হবে, এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না, বরং নির্বাচন কমিশনের সদস্য কারও কারও কথায় মনে হচ্ছে তাঁরা সরকারের প্রতি অনেক বেশি ‘আস্থাশীল’।

আরও পড়ুন

গত ১ জানুয়ারি রাজধানীর নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া, না নেওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আনিছুর রহমান বলেন, ইসি নট লিগ্যালি বাউন্ড টু ব্রিং পার্টিস টু পুলস (ডেইলি স্টার, ২ জানুয়ারি ২০২৩)। তাঁর এ কথার সরল অর্থ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে নির্বাচন কমিশন আইনগতভাবে বাধ্য নয়। তাঁর বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই এবং নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলো কি হলো না, তাতে তাদের কিছু যায়-আসে না।

আনিছুর রহমানের এই কথাবার্তায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী হওয়া তো যায়নি, বরং ‘হতাশ’ হতে হয়। কোনো দলকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) আবু হেনা বলেছেন, নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হয়, তাহলে সে নির্বাচন অর্থহীন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। তাদের কাজের মাধ্যমে দেখাতে হবে যে তারা নিরপেক্ষ (প্রথম আলো অনলাইন, ২১ ডিসেম্বর ২০২২)।

গত দুই নির্বচনের অভিজ্ঞতায় দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ ও সাহসী ভূমিকা রাখতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এই বাস্তবতায় বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে তার সমালোচনা করা কঠিন। সরকারি দলের কথাবার্তায় এটা স্পষ্ট যে ‘সংবিধান রক্ষার’ স্বার্থে তারা আগের দুটি নির্বাচনের মতো আরেকটি নির্বাচন করতে পিছপা হবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য যেন সংবিধানই প্রধান বাধা।

সংবিধানকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল শেষ পর্যন্ত সফল হবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হয়, তাহলে সেই  নির্বাচন হবে অর্থহীন—এতে কোনো সন্দেহ নেই।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক