মিছিল–সমাবেশ বাংলাদেশি গণতন্ত্রের গয়না। বলা হয়ে থাকে, সর্বপ্রথম যাঁর নেতৃত্বে এই অঞ্চলে মিছিল হয়েছিল তিনি হলেন শ্রীচৈতন্যদেব; তিনি মিছিল নিয়ে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের দরবারে গিয়েছিলেন। কৌতুকসম্রাট ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘বাঙালি শ্রীচৈতন্য–অন্তঃপ্রাণ, তাই মিছিল তাগো অন্তরের জিনিস।’
সেই ‘অন্তরের জিনিস’ তথা মিছিল-সমাবেশ গত কয়েক বছর এ দেশে ভালোমতো হয়নি বা হতে পারেনি কিংবা বলা যায়, হতে দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভূষণ হলো বিরোধী পক্ষ মিছিল–সমাবেশে ‘মানি না! মানব না!’ বলতে থাকবে, আর সরকার সেই ‘মানি না’মুখর মিছিলকে মেনে নিয়েই বিরোধীদের তা মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করবে।
বাঙালির রাজনৈতিক মেজাজ মূলত ‘প্রেশার কুকার পলিটিকসে’ অভ্যস্ত। প্রেশার কুকারের ঢাকনা টাইট করে আটকে চুলায় চাপালে তাতে কুকারের ভেতরে বাষ্প ঘনীভূত হয়। মাঝে মাঝে ‘শিস দেওয়ার’ ব্যবস্থা রাখা হয়, যাতে বাষ্পের খানিকটা বের হতে পারে। নইলে বাষ্প ভেতরে পুঞ্জীভূত হতে হতে গোটা প্রেশার কুকারটাই বোমার মতো বিস্ফোরিত হতে পারে। বিরোধীদের রাস্তায় নেমে হাত–পা ছুড়ে ‘মানি না, মানব না’ স্লোগান দেওয়া হলো সেই প্রেশার কুকারের শিস। সমাবেশ ও মিছিল হলো তার ব্রিদিং গ্রাউন্ড।
শুশুক যেমন শ্বাস নেওয়ার জন্য ভুস করে পানির নিচ থেকে উঠে মাথা জাগায়; ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধীরাও শ্বাস নিতে, অর্থাৎ ভেতরের ক্ষোভ উগরে খানিকটা হালকা হতে সমাবেশ করে, মিছিলে মিলিত হয়।
এক দশকের বেশি সময় ধরে বিএনপি কঠিন চাপে ছিল। গত তিন–চার বছরে সেই চাপে তারা রাজনৈতিক শ্বাস নিতে পারেনি। টানা ‘দৌড়ানির ওপর’ রেখে সরকার এ দেশের বিরোধীদের তথা বিএনপির শ্বাসকষ্ট বাধিয়ে দিয়েছে।
বছরখানেক আগে একদিন সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারের পাশে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আচমকা দেখি বড়জোর ২০-২৫ জন যুবক কোত্থেকে এসে তাড়াহুড়া করে বস্তাজাতীয় কিছুর ভেতর থেকে বাঁশের লাঠি বের করলেন।
প্রতিটি লাঠির আগায় চট প্যাঁচানো। চোখের নিমেষে তাঁরা কেরোসিনজাতীয় দাহ্য পদার্থে চুবানো চটে দেশলাই জ্বেলে মশাল ধরালেন। তাঁদের তাড়াহুড়ার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাঁরা চরমপন্থী আন্ডারগ্রাউন্ড কোনো দলের সদস্য।
তাঁরা মশাল হাতে ঝটিকা মিছিল শুরু করলেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়ার পাশাপাশি ‘মানি না, মানব না’ধর্মী স্লোগান শুরু হলো। দলের কয়েকজন মোবাইলে সেই মিছিলের ছবি তুলতে লাগলেন। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে দেখি ‘ধর! ধর!’ শোর চিৎকার করে কারওয়ান বাজারের ভেতর থেকে কিছু লোক দৌড়ে আসছে। ‘মানি না, মানব না’ পক্ষের মিছিলকারীরা মশাল-টশাল ফেলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ‘নাই’ হয়ে গেলেন। দুই মিনিটের চোরাগোপ্তা মিছিল এক ধাওয়াতেই শেষ হয়ে গেল।
কিছুদিন আগপর্যন্ত বিএনপির জন্য মিছিল–সমাবেশ করা প্রচণ্ড কঠিন ছিল। ধারাবাহিক হামলা–মামলা–গ্রেপ্তারে তারা বলা যায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। সে কারণে বিএনপিকে অনেক সময় নিষিদ্ধ দলের মতো ‘ঝটিকা মিছিল’ করতে হয়েছে। হরেদরে মিছিল–সমাবেশ করার কোনো কায়দা বিএনপির ছিল না।
সম্প্রতি ঢাকায় আবার বিএনপির মিছিল-সমাবেশ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রায় নিয়মিত ভিত্তিতে মিছিল–সমাবেশ করে যাচ্ছে। তবে এবারের লক্ষণীয় দিক হলো, মিছিলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের চোখেমুখে আগের মতো আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা মোটামুটি শঙ্কাহীনভাবে মাঠে নামছেন।
কিছুদিন ধরে বিএনপি যেদিন ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ’ ডাকছে, ‘কাকতালীয়ভাবে’ ওই দিনই আওয়ামী লীগের ‘শান্তি সমাবেশ’ হচ্ছে। দুই পক্ষেরই ‘এক দফা, এক দাবি’। একপক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট চায়, আরেক পক্ষ সরকারের অধীনে চায়। দুই পক্ষই মনে করছে, নিজেদের দাবি নিয়ে আপস করার সুযোগ নেই। ফলে ‘ফিরিবার পথ নাহি’। একজন বলছে, ‘হতে হবে’; অন্যজন বলছে, ‘কাভি নেহি’। ফলে বিষয়টি এখন ঘোরতর চিন্তারই হয়ে উঠেছে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবারের বিএনপির মহাসমাবেশ ও আওয়ামী লীগের ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ শীর্ষক জমায়েত রাজনীতিতে কী বার্তা দিতে যাচ্ছে, সেই দিকে এখন সবার চোখ। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘খবর পাচ্ছি, সীমান্ত থেকে অস্ত্র কিনছে তারা (বিএনপি)।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ তাদের অস্ত্র সরবরাহের একটি ঘাঁটি। আগ্নেয়াস্ত্র এনে তারা মজুত করছে।’ তিনি বলেছেন, মহাসমাবেশের নামে বিএনপি বিশৃঙ্খলার দিকে গেলে, তা প্রতিহত করা হবে।
অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, একই দিনে সমাবেশ ডেকে আওয়ামী লীগ পায়ে পাড়া দিয়ে সংঘাত বাধাতে চায়। ফখরুল বলেছেন, ওবায়দুল কাদের বিএনপি সীমান্ত থেকে অস্ত্র আনছে বলে যে কথা বলেছেন, সেটি জনগণের আন্দোলন রুখে দেওয়ার নতুন চক্রান্ত। জনগণের ওপর কেউ অস্ত্রবাজি করলে তার দায় সরকারকে নিতে হবে। ফখরুল বলেছেন, সমাবেশ ঘিরে কোনো সংঘাত বাধলে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে।
এত দিন নেতাদের মুখে সমাবেশ ঘিরে ‘অস্ত্রপাতির’ কথা শোনা যায়নি। কোথাও তেমন কোনো গন্ডগোলও হয়নি। কিন্তু এখন কী এমন হলো যে অস্ত্র এবং মারামারির কথা আসছে?
সরকার ও বিরোধী দল উভয়েই প্রকারান্তরে সংঘাতের কথা বলছে। দুই পক্ষই বলছে, ‘খেলা হবে’। সমস্যা হলো এই খেলায় পক্ষ দুটি না। দুই পক্ষের পিঠ চাপড়ানির জন্য বাইরের বড় বড় কোচ আছে। দেশি খেলোয়াড়দের সামনে রেখে পেছন থেকে প্রক্সি খেলোয়াড় হিসেবে বিদেশি খেলোয়াড়েরা খেলছেন।
বিদেশি কূটনীতিকেরা সমানে দৌড়ঝাঁপ করছেন। ফলে ‘খেলা হবে’ বলে খেলতে নামা দুই পক্ষের খেলাটিকে এখন আর ঘরোয়া ‘ছেলেখেলা’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক খেলায় রূপ নিয়েছে।
দুঃখ নম্বর ১. ১৭ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা করা এই খেলা আমরা দেখতে চাই না। তারপরও দর্শক গ্যালারিতে আমাদের বসতে বাধ্য করা হয়েছে। তা–ও ফাউ টিকিটের দর্শক হিসেবে না। এই ব্যয়বহুল খেলা আয়োজনের সব খরচ আমাদের মতো দর্শকদের কাছ থেকে তোলা হচ্ছে। তোলা হবে। দুঃখ নম্বর ২. এ ম্যাচের খেলোয়াড় লোকাল, আম্পায়ার আন্তর্জাতিক!
খেলা উত্তেজনাকর জায়গায় চলে যাচ্ছে। আগামীকালের দুই পক্ষের সমাবেশকে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই সমাবেশ দুটিকে কেউ কেউ চলমান রাজনীতির ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, বিএনপি বড় ধরনের কোনো সভা-সমাবেশের ডাক দিলে সেই দিন তো বটেই, তার আগের দিনও বাস-লঞ্চের শ্রমিকদের বিশেষ কাজ পড়ে যেত। সেই দিন তাঁরা গাড়ি বা লঞ্চ চালানো বন্ধ রেখে হলিডে মুডে থাকতেন।
দক্ষিণবঙ্গের লঞ্চগুলো বিশ্রামে থাকত। অন্যান্য জায়গার বাসগুলো রেস্টে থাকত।
সম্প্রতি খুলনায় বিএনপির সমাবেশের দিনও আশপাশের জেলার পরিবহন শ্রমিকদের বিশেষ কাজ পড়েছিল। সেদিনও খুলনাগামী বাস বন্ধ ছিল।
কিন্তু আগামীকালের মহাসমাবেশের আগে বাস–লঞ্চের শ্রমিকদের এখনো সে ধরনের ছুটি নেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ চৌকি বসিয়ে ঢাকায় আসা লোকজনের দেহতল্লাশি করছে।
তবে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল, তাতে মনে হয় বিএনপি মরিয়া হয়ে জমায়েতে সর্বোচ্চসংখ্যক লোকের উপস্থিতি ঘটানোর চেষ্টা করবে। ধারণা করি, পুরো বিষয়টিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রাখছে সরকার। আন্দাজ করা যেতে পারে, বিরোধীদের কর্মী–সমর্থকেরা যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে পুলিশও কান খাড়া করে আছে।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, আসলেই ‘খেলা হবে’। সে খেলা ফুটবল-ক্রিকেটের মতোই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। এই ক্ষেত্রে আমাদের দুঃখ মূলত দুটো।
দুঃখ নম্বর ১.
১৭ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা করা এই খেলা আমরা দেখতে চাই না। তারপরও দর্শক গ্যালারিতে আমাদের বসতে বাধ্য করা হয়েছে। তা–ও ফাউ টিকিটের দর্শক হিসেবে না। এই ব্যয়বহুল খেলা আয়োজনের সব খরচ আমাদের মতো দর্শকদের কাছ থেকে তোলা হচ্ছে। তোলা হবে।
দুঃখ নম্বর ২.
এ ম্যাচের খেলোয়াড় লোকাল, আম্পায়ার আন্তর্জাতিক!
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]