‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগকে ডেকে পাঠান। তিনি পুলিশ ডাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলো সহিংস উপায়ে খালি করে দিতে, যেখানে শিক্ষার্থীরা গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ করছিলেন।’
ফিলিস্তিনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং ইসরায়েলের দখলদারত্বের অবসান দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অভূতপূর্ব ছাত্র বিক্ষোভের জন্ম হয়েছে, তা নিয়েই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এই টুইট করা হয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনের এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকার মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কলাম্বিয়া, ব্রাউন, ইয়েল, হার্ভার্ড, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন, ইউসিএলএ-সহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন বিক্ষোভ দমাতে ন্যাশনাল গার্ড ডাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি একাডেমিক ভবন অধিকারে নিয়ে সেখানকার হ্যামিল্টন হলের নাম পাল্টে হিন্দ হল করেছে। হিন্দ রজব নামের পাঁচ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি শিশুকে ফেব্রুয়ারি মাসে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। দুই সপ্তাহ আগে সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েছিল সে, আর ইসরায়েলি সেনাদের গোলাগুলির মধ্যে আটকা পড়েছিল। তাঁর নামেই এই নামকরণ।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যামিল্টন হল সর্বশেষ এ ভবনটি শিক্ষার্থীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল ১৯৬৮ সালে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করে গড়ে ওঠা বিক্ষোভকালে।
দখলকৃত ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনিরা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘ছাত্র ইন্তিফাদার’ দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ছাত্ররা দাবি করেছে, যেসব কোম্পানি ইসরায়েলের দখলদারি ও গাজায় চলমান গণহত্যা থেকে মুনাফা তুলছে, তাদের কাছ থেকে তহবিল নেওয়া বন্ধ করতে হবে।
ফিলিস্তিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যাঁরা প্রতিনিয়ত ইসরায়েলি সেনাদের নৃশংস নিপীড়নের মুখোমুখি হন, তাঁরাও যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর যে ভয়ানক নিপীড়ন ও সহিংস আচরণ হচ্ছে তা দেখে আঁতকে উঠছেন। আমেরিকান রাজনীতিবিদেরা একই ধরনের মৌখিক আক্রমণ করে চলেছে। তারা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘ঘৃণা ও ইহুদিবিদ্বেষ’ ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছে।
আমি দুজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তানের বাবা। আমার ছোট মেয়েটি পশ্চিম তীরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। প্রতিদিনই তাকে নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।
বড় সন্তানটি আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে কারণে আমি খুব ভুলভাবে বিশ্বাস করেছিলাম, এ ধরনের নিপীড়নমূলক নীতির শিকার তাকে হতে হয় না। ফিলিস্তিন ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই জায়গাতেই আমার সন্তানদের ও তাদের সহপাঠীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। তা সত্বেও তাদের প্রচেষ্টায় আমি গর্বিত এবং সাহসী শিক্ষার্থীদের প্রতি জানাই সংহতি।
এখন যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে, সেটি হলো নিপীড়ন ও গ্রেপ্তার করে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন কি দমন করা যাবে? নাকি আন্দোলন আরও বেশি জনপ্রিয় হবে এবং নতুন নতুন ক্যাম্পসে ছড়িয়ে পড়বে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে ছড়িয়ে পড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের দিকে তাকাতে হবে। আমেরিকান নিরাপত্তা বাহিনী বল প্রয়োগ করেছিল, আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল।
ইসরায়েল যখন আগ্রাসনের তীব্রতা বাড়াচ্ছে, সে সময় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনিদের নৈতিক সমর্থন জোগাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ আরও আশা তৈরি করছে। এই প্রতিবাদ এই ইঙ্গিত দিচ্ছেছে যে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন একটা প্রজন্মের জন্ম হচ্ছে, যারা জায়নবাদী ভাষ্য বিশ্বাস করে না এবং মূলধারার পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ওপরও তাদের আস্থা নেই।
যেকোনো ইস্যুতে সাড়া দেওয়া এই তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে গভীরতর বোঝাপড়া করতে পেরেছে। ফলে পূর্বসূরিদের তুলনায় তারা সত্যকে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে এবং নিজেরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করছে।
যদিও এটা খুব আগাম বলে দেওয়া হবে যে এই আন্দোলন সরাসরি ইসরায়েলের দখলদারির অবসান ঘটাবে এবং ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সংকল্প ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার ভবিষ্যতে আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি বদলের ইঙ্গিতও দিচ্ছে।
মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে আশাবাদের জায়গা হলো, এই তরুণেরা একদিন প্রভাবশালী অবস্থানে আসবেন। বিশেষ করে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাজগতের অভিজাতশ্রেণির সন্তান।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অভিজাতেরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিগত, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক পরিসরে স্বাধীনতার হেফাজতকারী হিসেবে নিজেদের পরিচিত করে আসছেন। বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জমায়েত হওয়া ও বিক্ষোভ দেখানোর স্বাধীনতার কথা তাঁরা বলে আসছেন। যাহোক, তাঁরা তাঁদের এই দাবির পক্ষে নিজেদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ইসরায়েলের সমালোচনার সময় তাঁরা তাঁদের আসল চেহারা প্রকাশ করে দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির অভিজাতেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে নানাভাবে কালিমালিপ্ত করতে চাইছেন। এ দলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ও জনপ্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থায়নকারী এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমও রয়েছে। তাঁরা প্রতিবাদকারীদের উসকানিদাতা, ঘৃণা ছড়ানো ব্যক্তি এবং ইহুদিবিদ্বেষী বলে অভিযোগ করছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ আন্দোলনকে ‘ভয়ংকর’ বলে অভিহিত করে আন্দোলনকারীদের ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন।
এই আন্দোলনে কালো, লাতিনীয়, এশীয়, আরব, মুসলিম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইহুদি শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছেন। শুধু আরব ও মুসলিম নয়, প্রতিটি প্রতিবাদে কত বিচিত্র জাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছেন, সেটা পর্যবেক্ষকের নজর এড়ানোর কথা নয়।
এখন মিলিয়ন ডলারের যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে, সেটি হলো নিপীড়ন ও গ্রেপ্তার করে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন কি দমন করা যাবে? নাকি আন্দোলন আরও বেশি জনপ্রিয় হবে এবং নতুন নতুন ক্যাম্পসে ছড়িয়ে পড়বে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে ছড়িয়ে পড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের দিকে তাকাতে হবে। আমেরিকান নিরাপত্তা বাহিনী বল প্রয়োগ করেছিল, আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র আন্দোলন মার্কিন সমাজের বয়স্কদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের চিন্তার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যের একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে। নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরিদের মতো অন্ধভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করছে না। তারা ফিলিস্তিনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা, ইসরায়েলি দখলদারি ও গাজা যুদ্ধের বিপক্ষে।
ফারেদ তামাল্লাহ রামাল্লায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনি সাংবাদিক,
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদ মনোজ দে