সরকার চলতি অর্থবছরে দেশব্যাপী সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালুর ঘোষণা দিয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় পেনশন–সুবিধা পেতে হলে নাগরিকদের নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিতে হবে। একজন নাগরিক যদি ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সে নাম নথিভুক্ত করেন, তবে তাঁকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং যদি ৫০ বছরের বেশি বয়সে নথিভুক্ত করেন, তবে তাঁকে ন্যূনতম ১০ বছরের জন্য চাঁদা দিতে হবে।
সরকার এই পেনশন কর্মসূচিকে সর্বজনীন বললেও এ কর্মসূচির আওতায় পেনশন–সুবিধা পেতে হলে নিম্ন আয়ের মানুষকেও চাঁদা দিতে হবে। যাচাই করা প্রয়োজন, চাঁদার বিনিময়ে পেনশন কর্মসূচি আসলে সর্বজনীন হতে পারে কি না। এ জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গাইডলাইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত পেনশন কর্মসূচির তুলনা করে দেখা প্রয়োজন। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইএলও বিশ্বব্যাপী পেনশন–ব্যবস্থাসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বের বেশির ভাগ পেনশন–ব্যবস্থার ডিজাইন করা হয়েছে আইএলওর কারিগরি সহায়তার ভিত্তিতে।
পেনশন–ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো বয়স্ক ব্যক্তিদের আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দারিদ্র্য প্রতিরোধ করা এবং বৈষম্য হ্রাস করা। পেনশন–ব্যবস্থার ডিজাইনের ক্ষেত্রে আইএলও যেসব মূলনীতির কথা নির্দেশ করেছে, সেগুলোকে তিনটি প্রধান গ্রুপে ভাগ করা যেতে পারে: পেনশন–ব্যবস্থার আওতা কতটুকু, পেনশন পর্যাপ্ত কি না এবং ব্যবস্থাটি টেকসই কি না।
পেনশন–ব্যবস্থা এমন হওয়া প্রয়োজন, যেন তা দেশের প্রত্যেক নাগরিককে বৃদ্ধ বয়সে আয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে। সর্বজনীনতার এ নীতি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সনদের অন্তর্ভুক্ত। আর পেনশন–ব্যবস্থার পর্যাপ্ততা দুইভাবে বিবেচনা করা হয়: হরাইজন্টাল বা অনুভূমিক ও ভার্টিক্যাল বা উল্লম্ব। হরাইজন্টাল ডাইমেনশনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়, পেশা যা–ই হোক না কেন, বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে যেন প্রত্যেক নাগরিক বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পেনশনটুকু যেন পান।
প্রশ্ন হলো, নিম্ন আয়ের মানুষ কি প্রস্তাবিত পেনশন প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত চাঁদা দিতে পারবেন? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেখানে কোনো ধরনের চাঁদা ছাড়াই পেনশন পান, সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছ থেকে পেনশনের জন্য চাঁদা নেওয়া কি ন্যায্যতার দৃষ্টান্ত? এ ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে।
আর ভার্টিক্যাল ডাইমেনশনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় যে পেনশন–ব্যবস্থার সুবিধা এমন হওয়া প্রয়োজন, যেন তা বয়স্ক ব্যক্তির পূর্ববর্তী উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর পেনশন–ব্যবস্থাটিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হয়, যেন তা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হয়, অর্থাৎ এটি এমন কাভারেজ ও পর্যাপ্ততা অর্জন করতে পারে, যা আর্থিকভাবে টেকসই।
এই বহুমুখী উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য আইএলও একটি মাল্টিটায়ার বা বহুস্তরভিত্তিক পেনশন–ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। একাধিক স্তরের পেছনে মূল যুক্তি হলো, পেনশন–ব্যবস্থার আওতায় বিভিন্ন ধরনের মানুষকে তাদের জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজন হয়। একটি বহুস্তরভিত্তিক পেনশন–ব্যবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেসব স্তর থাকে, সেগুলো হলো করের অর্থে পরিচালিত পেনশন (টায়ার ০); একটি বাধ্যতামূলক, পেশাকেন্দ্রিক চাঁদা প্রদানভিত্তিক পেনশন (টায়ার ১) এবং সম্পূরক পেনশন (টায়ার ২)।
টায়ার ০ হলো একটি চাঁদাবিহীন পেনশন স্কিম, যার অর্থায়ন করা হয় জনগণের করের টাকায় সরকারের সাধারণ বাজেট থেকে। এই পেনশনের আওতায় একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর দেশের প্রত্যেক নাগরিকই পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন, তবে যদি কেউ অন্যান্য স্তরের পেনশনের আওতাভুক্ত হন, তাহলে তিনি আর টায়ার ০ পেনশন পাওয়ার যোগ্য থাকেন না। এ স্তরের পেনশনের পরিমাণ এমন হতে হয়, যেন একজন নাগরিক বৃদ্ধ বয়সে মর্যাদাপূর্ণ মানবিক জীবন যাপন করতে পারেন।
অন্যদিকে টায়ার ১ পেনশন হলো পেশাভিত্তিক। এই পেনশনের আওতাভুক্ত পেশাজীবীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদার বিনিময়ে নির্দিষ্ট পেনশন–সুবিধা ভোগ করেন। এই পেনশনে নিয়োগদাতা বা মালিকপক্ষ ও সরকারের নির্দিষ্ট পরিমাণ অবদান থাকে। পরিশেষে, টিয়ার ২ পেনশন স্কিমটি হলো স্বেচ্ছামূলক ও সম্পূরক চাঁদা প্রদানভিত্তিক পেনশন, যার মাধ্যমে ব্যক্তি আরও বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন।
আইএলও মনে করে, যাঁরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত এবং যাঁদের আয় এত কম যে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দেওয়া সম্ভব নয়, তাদের পেনশনের আওতায় আনবার একমাত্র উপায় হলো করের অর্থে পরিচালিত চাঁদাবিহীন পেনশন।
অর্থনীতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার বড় হলে শুধু চাঁদাভিত্তিক পেনশন চালু করা হলে দেশের জনগণের বড় অংশই পেনশনের আওতার বাইরে থেকে যায়।
এখন যদি আমরা আইএলওর বহুস্তরভিত্তিক পেনশন–ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবিত পেনশন কর্মসূচির তুলনা করি, আমরা দেখতে পাব, এর নাম ‘সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি’ বলা হলেও সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির একটি অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য এ পেনশন কর্মসূচিতে অনুপস্থিত। আর তা হলো করের অর্থে পরিচালিত চাঁদাবিহীন টায়ার-০ পেনশন। সরকারের প্রস্তাবিত পেনশন কর্মসূচির আওতায় একজনকে কমপক্ষে ১০ বছরের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ চাঁদা দিতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ব্যক্তিদের মাসিক চাঁদার হার সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা হতে পারে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের চাঁদার হার সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে। তাঁদের মধ্যে শুধু অসচ্ছলদের চাঁদায় ৫০ শতাংশ সহায়তা করবে সরকার। অন্যদের চাঁদায় সরকারের কোনো অবদান থাকবে না। পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা তাঁদের চাঁদার বিপরীতে সরকার থেকে সুদ পাবেন। এর মানে হলো প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমটি খুব কম সরকারি অনুদানভিত্তিক টায়ার-২ পেনশন–ব্যবস্থা। এ কারণেই জাতীয় সংসদে ‘সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩’ বিল পাস হওয়ার সময় বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য বলেছেন, এই পেনশন-ব্যবস্থা ব্যাংকের ডিপিএস স্কিমের মতো। জনগণ চাঁদা দেওয়ার পর সরকার কী পরিমাণ অর্থ দেবে, সরকারের অংশগ্রহণ কী হবে, তা আইনে পরিষ্কার নয়।
প্রশ্ন হলো, নিম্ন আয়ের মানুষ কি প্রস্তাবিত পেনশন প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত চাঁদা দিতে পারবেন? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেখানে কোনো ধরনের চাঁদা ছাড়াই পেনশন পান, সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছ থেকে পেনশনের জন্য চাঁদা নেওয়া কি ন্যায্যতার দৃষ্টান্ত? এ ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে।
২০০৯ সালের আগপর্যন্ত থাইল্যান্ডে সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি খাতের কর্মচারী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের জন্য বেশ কয়েকটি কন্ট্রিবিউটরি বা চাঁদাভিত্তিক পেনশন চালু ছিল। কিন্তু এর ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের খুব অংশই পেনশনের আওতায় এসেছিলেন। সব মিলিয়ে দেশের জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ পেনশনের আওতাভুক্ত ছিলেন। ২০০৯ সালের পর চাঁদাবিহীন করের অর্থনির্ভর পেনশন চালু করবার পরই কেবল থাইল্যান্ডের পেনশন সত্যিকার অর্থে সর্বজনীন হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধরনের পেনশন কর্মসূচির মাধ্যমে পেনশনের অনুভূমিক ও উল্লম্ব উভয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, আইএলওর দেওয়া তথ্যানুসারে, কানাডায় সব বয়স্ক ব্যক্তি চাঁদাবিহীন সর্বজনীন পেনশনের আওতাভুক্ত তুলনামূলক উচ্চ আয়ের নাগরিকদের জন্য স্বেচ্ছায় চাঁদা প্রদানভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের সরকারি–বেসরকারি পেনশনের ব্যবস্থা রয়েছে।
অন্যদিকে সুইডেনে পেনশন–ব্যবস্থার মূল উপাদান হলো একটি পেশাকেন্দ্রিক চাঁদা প্রদানভিত্তিক পেনশন (টায়ার ১)। কিন্তু যাঁদের আয় নেই বা আয় কম, তাঁদের জন্য রয়েছে গ্যারেন্টেড পেনশন (টায়ার ০)। পর্তুগালেও একটি বাধ্যতামূলক চাঁদা প্রদানভিত্তিক পেনশন–ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু যাঁদের পক্ষে চাঁদাভিত্তিক পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়, তাঁদের জন্য রয়েছে চাঁদাবিহীন সামাজিক পেনশন (টায়ার 0)।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এসব পেনশন–ব্যবস্থার মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা থাকলেও একটি বিষয় সব কটি পেনশন স্কিমের মধ্যেই দেখা যায়। আর তা হলো সব কটি পেনশন–ব্যবস্থাতেই চাঁদাবিহীন করের অর্থে পরিচালিত চাঁদাবিহীন পেনশন (টায়ার ০) কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত, যার মাধ্যমে পেনশন–ব্যবস্থায় নিম্ন আয়ের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব কর্মী ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের এক বৃহৎ অংশের পক্ষে চাঁদার বিনিময়ে পেনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ দুরূহ। এ কারণেই প্রস্তাবিত পেনশন কর্মসূচিকে সত্যিকার অর্থে সর্বজনীন করতে হলে এতে চাঁদাবিহীন পেনশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’।
ই-মেইল: [email protected]