সাম্প্রতিক কালে কয়েকজন অতি উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এর দু–একটি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানের আওতায় রয়েছে। তার মধ্যে আছেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক একজন আইজি।
অভিযোগটি প্রথম গত মার্চের শেষ দিকে ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকে ছাপা হয়। দুদকও অনুসন্ধান শুরু করতে বেশ সময় নেয়। শেষ পর্যন্ত তারা আদালতের আদেশ নিয়ে ক্রোকাবদ্ধ করেছে বিতর্কিত সম্পত্তি। বন্ধ করেছে ব্যাংক ও শেয়ার হিসাবের লেনদেন।
নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে সাবেক ওই আইজিপিকে পরিবারের সদস্যরাসহ হাজির হতে নোটিশও দেওয়া হয়। এর মধ্যেই গত মে মাসের শেষ দিকে গণমাধ্যম জানান দিল, তিনি সপরিবার দেশ ছেড়েছেন। অভিযোগ আছে সাবেক একজন সেনাপ্রধান সম্পর্কেও। এ বিষয়ে দুদকের কোনো কার্যক্রম এখনো লক্ষণীয় হয়নি।
এর মধ্যে নামে–বেনামে বিপুল বিত্তের অধিকারী হওয়া সম্পর্কে অভিযোগ আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন সদস্য সম্পর্কেও। অভিযোগ এসেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক একজন কমিশনার এবং কয়েকজন কর্মরত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও।
এমনিতে দুদক সম্পর্কে ধীরে চলার নীতি, ক্ষেত্রবিশেষে প্রভাবশালী মহলের ইঙ্গিতে চলাসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তাদের একটি অংশও দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এমন অভিযোগও করা হয়।
উল্লেখ্য, সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে মার্কিন সরকার। অন্যগুলো আমাদের গণমাধ্যমের অনুসন্ধানের প্রতিবেদন। এত উচ্চ পদাধিকারী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আসা বিরল। কোথাও কিছু ঘটলেও কেউ মুখ খুলত না। একটি ভীতির ভাবও এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে।
যেমন একজন স্বনামধন্য সম্পাদক সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, তাঁরা এর বেশ কটি জানতেন। ভয়ে প্রকাশ করেননি। তবে ইদানীং এসব সংবাদ প্রকাশে প্রত্যাশা আছে, বিচারের আওতায় আসবেন তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত যে কেউ। তাঁদের কেউ কেউ সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য করেছেন অনৈতিক সহযোগিতা। আমাদের প্রত্যাশা, কোনো প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে নয়, দেশের আইনের শাসন দেখতে চাওয়ার অভিপ্রায় থেকে।
রাজনৈতিক মহলে শুধু সরকারি দল নয়, বিরোধী দলে যাঁদের অবস্থান, তাঁরাও মনোনয়ন–বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। উল্লেখ করতে হয়, গণমাধ্যমের একটি অংশও এখন কলুষিত হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভারতের গত লোকসভা নির্বাচনে ‘গদি মিডিয়া’ বলে একটি শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ আমরা সচেতনভাবে লক্ষ করেছি। কিন্তু আমাদের এখানে প্রতিবাদী কণ্ঠ প্রায়ই ভয়ে বা অন্য কোনো অজানা কারণে চুপসে থাকে।
এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেক মন্তব্য আসছে। তদন্ত ও বিচারের আগে কারও চরিত্র হননের চেষ্টা বলেও আখ্যায়িত করছেন কেউ কেউ। এরই মধ্যে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একটি বিবৃতি আমাদের নজরে এসেছে। তারা এ ধরনের অভিযোগের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে জড়িয়ে ফেলার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। দাবি করছে, এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সরকারের কাছে এগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতেও প্রস্তাব রেখেছে। তারা আশা করছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা হবে।
বিবৃতিটি দেখে প্রাথমিকভাবে কিছুটা হোঁচট খেতে হয়। ঢালাওভাবে কেউ বলছে না পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দুর্নীতিপরায়ণ। তাঁদের মধ্যে উঁচু মানের সৎ কর্মকর্তাও রয়েছেন। কর্মজীবনে আমি এ ধরনের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সান্নিধ্যে আসার বিষয়টি গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করি। সর্বত্র বলেও থাকি। তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতেই পারে। তা এলে আইনানুগভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ সেসব বিষয়ে যথাসময়ে যথোচিত ব্যবস্থা নিলেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
পুলিশ বাহিনীর নিম্নপদস্থ কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে ইদানীং ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও প্রায়ই আসে। কেউ কেউ ধরাও পড়েন। কিন্তু শেষাবধি কী হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই জানা যায় না। এ ক্ষেত্রে বলা চলে, এ–জাতীয় পুলিশ সদস্যরাই সংস্থাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য ভূমিকা রেখে চলছেন। তাই গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশের আগে সৎ কর্মকর্তাদের তো তাঁদের ঘরের দিকে অধিকতর নজর দেওয়া আবশ্যক। অবশ্য শব্দচয়নে সাবধানতা অবলম্বন করতে পরামর্শ তাঁরা দিতে পারেন। তবে এমন কোনো অবস্থান নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে গণমাধ্যম এ ধরনের সংবাদ প্রকাশে বৈরী পরিস্থিতিতে পড়ে।
সাবেক সেনাপ্রধান সম্পর্কে সেনাবাহিনীর কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত কেউ কোনো মন্তব্য করেননি। তাই ধরে নেওয়া যায়, আইন চলবে স্বাভাবিক গতিতে। এনবিআরের সদস্য সম্পর্কে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে এর চেয়ারম্যানের বক্তব্যকে অকারণে পাশ কাটানো বলে মনে করা যায়। তাঁরও আইনানুগ নিষ্পত্তির পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়া সমীচীন। এর তো এখনো অনুসন্ধানই হয়নি। সাবেক আইজিপি ছাড়া অন্য পুলিশ সদস্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বলা চলে, অভিযোগের সূচনা হয়েছে মাত্র।
এ ধরনের অভিযোগ আসা সম্পর্কে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের কিছু বিপরীতধর্মী মতামতে আমরা বিস্মিত। একবার বলেন, সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে। এর কোনো দায় সরকার নেবে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগকে ঢালাও প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলেও মন্তব্য করছেন কেউ কেউ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তো তথ্য মন্ত্রণালয়ের নজরেও বিষয়টি এনেছে। প্রকৃতপক্ষে কেউ ঢালাওভাবে কোনো বাহিনীকে অভিযুক্ত করেননি। করতে পারেনও না। যে বা যারা অপরাধী, তারা ক্ষমতাবলয়ের নৈকট্যের জন্য দায়মুক্তি না পাক—এ প্রত্যাশা সবার। সবাই চায় আশু অনুসন্ধান, তদন্ত ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিচার।
এ কথা সত্য, দুর্নীতি রকমভেদে সব সময়ই ছিল। হয়তোবা হেরফের ঘটেছে সময় ও সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। আর এর পরিসর বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে দেশের বিরাজমান অঘোষিত একটি দায়মুক্তি ব্যবস্থা। দুর্নীতি চলছে সব প্রতিষ্ঠানে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ কারও অজানা নয়।
শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা ভবন—এদের কথা নতুন করে না–ই বললাম। জনপ্রশাসনের একটি মূল অঙ্গ ভূমি প্রশাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি ও জনগণের হয়রানি কারও অজানা নেই। প্রকৌশলী থেকে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহসহ সেবাদানকারী প্রতিটি সংস্থা আজ দুর্নীতি ও জনভোগান্তির ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিচারাঙ্গনে জনভোগান্তিও বহুল আলোচিত।
এ ধরনের সব প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়াও রয়েছেন অনেক সৎ ও নিবেদিত কর্মকর্তা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বও বাদ যায়নি। সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিদেশে প্রভূত সম্পদ থাকার তথ্য টিআইবি জনসমক্ষে এনেছে। তিনি নির্বাচনের হলফনামায়ও এসব সম্পদের বিবরণ দেননি। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। এই সম্পদের উৎস কিংবা বিদেশে টাকা পাচার সম্পর্কে সরকার অনুসন্ধানের জন্য কোনোরূপ ব্যবস্থা নিয়েছে, এমনটা জানা যায়নি।
উল্লেখ্য, রাজনৈতিক মহলে শুধু সরকারি দল নয়, বিরোধী দলে যাঁদের অবস্থান, তাঁরাও মনোনয়ন–বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। উল্লেখ করতে হয়, গণমাধ্যমের একটি অংশও এখন কলুষিত হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভারতের গত লোকসভা নির্বাচনে ‘গদি মিডিয়া’ বলে একটি শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ আমরা সচেতনভাবে লক্ষ করেছি। কিন্তু আমাদের এখানে প্রতিবাদী কণ্ঠ প্রায়ই ভয়ে বা অন্য কোনো অজানা কারণে চুপসে থাকে।
উল্লেখ্য, দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি মহল অর্থনীতিকে চালানোর ক্ষমতাও দৃশ্যমানভাবে নিয়ে নিয়েছে। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রক্ষণশীল হিসাবেই দুই লাখ কোটি টাকার বেশি। এর একটি বিরাট অংশকে আত্মসাৎ বলা বা দায়ী ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনা দোষের হবে না।
বিদেশে টাকা পাচারের বড় কারবারি তাদেরই কেউ কেউ। দেশের ব্যাংক খাতকে যদি আমরা নিয়ম–নীতির মধ্যে আনতে পারি, তাহলে এভাবে খেলাপি হওয়ার নামে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের পরিমাণ অনেক কমে যাবে।
বেশি দিন আগের কথা নয়, আন্তর্জাতিক দুর্নীতি সূচকে আমাদের অবস্থান ছিল ‘শীর্ষে’। কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়ায় অবস্থানের ঈষৎ উন্নতি ঘটেছে। অন্য কয়েকটি দেশ আমাদের প্রতিযোগিতায় একটু পেছনে ফেলেছে। তবে খুব বেশি ফেলতে পারেনি।
এ অবস্থায় যখন কর্মরত বা সাবেক কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তখন এটা সেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী—এমন ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে এ ধরনের সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশকে অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও আখ্যায়িত করার কোনো সুযোগ নেই।
● আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব