বাংলাদেশের বিনিয়োগ–সম্ভাবনা বা বিনিয়োগ নিয়ে যখনই কাজ করতে গিয়েছি, তখনই বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যানের ঘাটতি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে পাস্তুরিত দুধের চাহিদা কত, স্থানীয় উৎপাদন কত, আমদানি কত—বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য নেই। তথ্য নেই সিমেন্ট খাত, ফল, মধু, এমনকি খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বা মজুতেরও। এ কারণে বিগত সরকার প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে গল্পের ফাঁদ পেতেছিল, তারও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অনেককেই গোপনে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ‘ডেটা ম্যাসাজিং’–এর জন্য দায়ী করতে শুনেছি। তিনি নাকি প্রায়ই উপাত্তকে রঙিন করে দেখানোর জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) চাপাচাপি করতেন।
আমরা জানি, দেশের সরকারি পরিসংখ্যান দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। পরিসংখ্যানগুলোয় নেই বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক জিডিপি প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে রপ্তানি বাণিজ্য, রিজার্ভ, রাজস্ব আহরণ ইত্যাদি বিষয়ের তথ্যে বড় ধরনের গরমিলের কথা শোনা গেছে। ফলে সংকটে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গৃহীত কোনো নীতিই বিগত বছরগুলোয় সেভাবে কার্যকর হয়নি। বেশ কিছুদিন ধরেই তথ্যের অসংগতি বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে সামষ্টিক অর্থনীতিতে। কারণ, সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া কার্যকর নীতি প্রণয়ন সর্বদাই ব্যাহত হয়।
প্রায়োগিক পরিকল্পনায় সামষ্টিক অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে, এমন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে গতি আনতে সম্পৃক্ত সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে হবে
পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রাট তৈরি হওয়ার পেছনে সহজ ভাষায় প্রধান দুটি কারণ থাকতে পারে। এক. যদি কোনো অদক্ষ ব্যক্তিকে দিয়ে গোঁজামিল দিয়ে কাজটি করানো হয়। দুই. যদি পরিসংখ্যানের রাজনৈতিকীকরণ করা হয়। পত্রিকান্তরে জানা গিয়েছে, দ্বিতীয় কারণটিই দেশে পরিসংখ্যানবিভ্রাটের সবচেয়ে বড় কারণ। আগেই বলেছি, বানোয়াট পরিসংখ্যান বানানোর কাজটি করা হতো সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে। তিনিই ছিলেন কৃত্রিম পরিসংখ্যানের প্রধান পরিকল্পনাকারী।
২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিসংখ্যানবিভ্রাট আরও প্রকট হয়। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও বাড়তে থাকে পরিসংখ্যানগত ব্যবধান। এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল বিগত অনেক দিনের সরকারের পরবর্তী মেয়াদেও। বলা হয়, সাবেক এই মন্ত্রী ছিলেন মেধাবী হিসাববিদ। কিন্তু তাঁর এ জ্ঞানকে ভালো কাজে ব্যবহার না করে মেকি পরিসংখ্যান তৈরির কাজে লাগিয়েছে সরকার। ওই সরকারের পরবর্তী মেয়াদে তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন।
পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি জাতীয় অর্থনীতির লক্ষ্য নির্ধারণ, নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আস্থার সংকট তৈরি হয়, দেশের অভ্যন্তরেও ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও অনাস্থা তৈরি হয়।
ইতিহাস বলে, পরিসংখ্যানকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেললে তা সঠিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ে যায় সামষ্টিক অর্থনীতি। দেশে রাজনৈতিক কারণে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে সরবরাহ করা হয়েছে বিকৃত পরিসংখ্যান। এসব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণের কারণেই ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতে।
এ পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে পরিসংখ্যানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা জরুরি। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের যেকোনো নীতি প্রণয়নের আগে এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। অবশ্য এরই মধ্যে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও করণীয় নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তথ্য-উপাত্তের সঠিকতা যাচাই করতে ডেটা কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, এ কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানও পর্যালোচনা করা হবে। তা ছাড়া কর্মসংস্থান, মজুরিসহ যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের এখনো নেই, সেগুলোর কাজও শুরু করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের ২৫টি সূচক বিবেচনায় তৈরি হওয়া ২০১৪ সালের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ছিল ১০০-এর মধ্যে ৮০ আর মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচক ছিল ৭০। কিন্তু এর পর থেকে দুটি স্কোরই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। সবচেয়ে বড় পতন দেখা যায় পদ্ধতিগত স্কোরে। ২০১৪ সালের স্কোর ৭০ থেকে ২০২০ সালে পদ্ধতিগত স্কোর অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে। বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে আস্থা ফেরাতে হলে বিশ্বব্যাংকের এ সূচকের স্কোর বাড়ানোয় কাজ করতে হবে।
বিবিএস দেশের সব ধরনের সরকারি পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রকাশ করে। বিবিএসের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটিতে বানোয়াট পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না, কেউ ন্যূনতম আপত্তি তুললে তাঁকে বদলি করে দেওয়া হতো। এমনকি বিনা কারণে হয়রানির জন্য বিভাগীয় মামলাও করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এই কাজের দায় ভাসা–ভাসা কাজ করা অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদদেরও নিতে হবে।
পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তির সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। পাশাপাশি যাঁদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে, তাঁদের ন্যায্যতা প্রাপ্তিও জরুরি। দক্ষ পরিসংখ্যানবিদদের ফিরিয়ে আনতে হবে কিংবা নতুন করে বিবিএসে যোগ্য পরিসংখ্যানবিদ নিয়োগের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তৎকালীন ওই মন্ত্রী বিবিএসে তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট বিনা যোগ্যতা বিচারে যাঁদের বসিয়েছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় এনে প্রয়োজনমাফিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রায়োগিক পরিকল্পনায় সামষ্টিক অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে, এমন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে গতি আনতে সম্পৃক্ত সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে হবে। অতীতে বিভিন্ন দাতা সংস্থা যদিও এ কাজে অনেক অর্থ ব্যয় করেছে, তবে রাজনৈতিক কারণে তেমন ফল মেলেনি। অথচ আমরা সবাই জানি, চাহিদা ও জোগানের অঙ্কটি ঠিক না করে আমাদের বিনিয়োগ–বন্ধ্যত্ব কাটবে না।
মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক