ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্যের একটা তালিকা প্রকাশ করে থাকে। বাংলাদেশ এই তালিকায় ৫৯তম। সে তুলনায় জাপান, যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি, সে দেশের অবস্থান ১২৫তম। জাপানের সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি, রাজনীতি আর প্রচারমাধ্যমের প্রভাবে আমিও অধিকাংশ জাপানি পুরুষের মতো ‘প্রকৃত পুরুষে’র একটা সংকীর্ণ ধারণায় দীক্ষিত ছিলাম।
চাকরির বাজারের বড় কোনো অবস্থান করে নেওয়াটাই ছিল এই প্রকৃত পুরুষদের কাছে সামাজিক সম্মান। পৌরুষ বলতে বুঝতাম আগ্রাসন, অন্যকে পদানত করা ছিল শক্তিসামর্থ্যের প্রমাণ। এই চক্করে পড়ে পুরুষত্ব বিষয়টি হয়ে উঠেছিল এক দুর্ভেদ্য কেল্লার মতো। আবেগ আর বন্ধনমুক্ত হওয়া, দুর্বলতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন প্রকাশ না করাই ছিল আমাদের কাছে পুরুষত্বের প্রমাণ। ফলে আমাদের সম্পর্কগুলো সমতা কিংবা নির্ভরতা হারিয়ে হয়ে উঠল নিয়ন্ত্রণ আর জবরদস্তিমূলক।
আমাদের বলা হলো ‘রক্ষাকর্তা’। এই ভাবমূর্তির অন্ধকারে জন্ম নিল সহিংসতা, নারীবিদ্বেষ আর নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য।
আমার মনে আছে, ছোটবেলায় কান্না আটকাতে ঠোঁট কামড়ে থাকতাম প্রায়ই। পুরুষদের যে কাঁদতে মানা! আমার উচ্চবিদ্যালয়ের রাগবি দলে শেখানো হতো শক্তি আর সাফল্যের জোরে যেকোনো দুর্বলতা জিতে নেওয়া চলে।
নিজের অবচেতনে একজন লড়াকু পুরুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য আমি খুব পড়তাম ও পরিশ্রম করতাম। টোকিওতে ২৫ বছর আগে আমার কর্মজীবন শুরু হয়। সে আমলে মেয়েরা কেবল অফিসের ছোটখাটো টাইপিস্ট, কেরানির কাজ করতেন। আমার এবং আরও সবার কাছে এ ছিল খুব স্বাভাবিক ও নিত্যকার বিষয়।
পরে দীর্ঘ প্রবাসজীবনে আবিষ্কার করলাম, গোটা দুনিয়াতেই নারীদের প্রতি কমবেশি একই মনোভাব বিদ্যমান। তা সে এশিয়ার সবুজ গ্রাম, ইউরোপের ঝাঁ–চকচকে শহর কিংবা আফ্রিকার কোনো অজপাড়াগাঁ—সবখানেই সেই চিরাচরিত গল্প। দেখলাম, সর্বত্র পুরুষেরা ‘পুরুষত্ব’–এর এক অলীক ঘেরাটোপে আটকে পড়েছে, আর এর ফলে কী নিদারুণ মূল্য চোকাতে হচ্ছে, সে ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণাই নেই। বাংলাদেশে, আশা আর সহনশীলতার এই অপূর্ব সম্মিলনের দেশেও চিত্রটা একই।
পুরুষত্বের নামে প্রচলিত অচল আর বিষাক্ত কিছু প্রথার পাল্লায় পড়ে আমাদের আশপাশে যারা আছে, বিশেষ করে পরিবার আর সমাজের মেয়ে আর নারীরাও সমানতালে ভুগছে।
নিরীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, ‘পৌরুষ’ জাহিরের নেশায় আক্রান্ত পুরুষদের পক্ষে তাদের সঙ্গিনীর কাছে মনের ভাব প্রকাশ করা অপেক্ষাকৃত কঠিন। ফলে অনিবার্যভাবে বাধে সংঘাত। ফলাফল নারীর প্রতি সহিংসতা। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মেয়েই এর ভুক্তভোগী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সহিংসতার অপর প্রান্তে থাকে ওই নারীটির জীবনসঙ্গী (সূত্র: ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন, ২০২৫, বিবিএস)।
কিন্তু এই আগ্রাসন আর নারীদের দমনপীড়ন করে পৌরুষ প্রমাণের সামাজিক চাপের মুখে আমরা কী হারাচ্ছি, তা–ও ভাবা দরকার। মানসিক ও শারীরিক চাপের পাশাপাশি সামাজিক অর্থনৈতিক মাপকাঠি বিবেচনায় আমাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ শতকোটি ছাড়িয়ে যাবে। এর চেয়েও বড় ক্ষতি হচ্ছে, জীবনের সুখ-আনন্দ উপভোগের ক্ষমতা ও সুযোগ হারানো, জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলা, তাড়না খুইয়ে বসা।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। আমার সন্তান জন্মের পরবর্তী বছরগুলোয় আবিষ্কার করলাম, আমরা, পুরুষেরা নিজেদের দুর্বলতা মেনে নেওয়া ও প্রকাশের ক্ষমতাকে, অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং সুখী ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার ক্ষমতাকে কী নিদারুণভাবে অবজ্ঞা করে চলেছি। পুরুষত্ব নামক বাক্সটা আমাদের নির্মমভাবে বন্দী করে রাখে। আমার ‘ইকিগাই’ প্রাপ্তি হলো। জাপানি এই শব্দটির অর্থ—নিজেকে খুঁজে পাওয়া, জীবনধারণের উদ্দীপনাকে ফিরে পাওয়া।
জাতিসংঘে কাজ করার সুবাদে আমি আমার পিতৃত্বকালীন ছুটির সবটা এই পুরুষত্বের বাক্সটা ভেঙে বেরোনোর কাজে ব্যয় করলাম। এ কেবল বাবা হওয়ার অংশ নয়, বরং একই সঙ্গে বহু বছরের শিক্ষা মুছে নতুনভাবে একজন পুরুষ, একজন বাবা, একজন মানুষ ও একজন সঙ্গী হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করাও বটে।
অন্দরমহলের কাজকর্ম ও বাচ্চার দেখভালের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার পর দেখলাম কোনোভাবেই আমাদের রান্নাঘর, থাকার ঘর, শোবার ঘর কিংবা বাথরুম অর্থাৎ আমার নতুন কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক কিছু পাচ্ছি না, বরং এটা শেখা ও একসঙ্গে বেড়ে ওঠার জন্য দারুণ স্থান। বাচ্চা কোলে নির্ঘুম রাতের যন্ত্রণা আমার পুষিয়ে গেল সঙ্গিনীর সঙ্গে পালা করে ঘুমের গীত গেয়ে, বাচ্চার ডায়াপার পাল্টানোর মুহূর্তটা হয়ে উঠল সঙ্গিনীর সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিত হওয়ার।
প্রচলিত সামাজিক বোঝাগুলো ঘাড় থেকে নেমে যেতে আবিষ্কার করলাম, প্রকৃত শক্তি আসলে আবেগকে দমন করা নয়, বরং সেগুলো প্রকাশের মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, অন্যকে বুঝতে শেখা এবং কোনো রকম জড়তা বা দ্বিধা ভিন্ন ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারা।
কাজেই ভঙ্গুরতা হয়ে উঠল আমার শক্তির স্থান। লালন-পালনের মাধ্যমে প্রমাণ করলাম সহনশীলতা আর অন্য লোকের মন্তব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রচলিত ‘পুরুষত্ব’–এর বাক্স গুঁড়িয়ে দেখালাম শক্তির বহিঃপ্রকাশ। সহনশীলতা, অপরকে বোঝার মানসিকতার চর্চা আর আমার পরিবারের জীবনে সদা উপস্থিত থাকার এক নতুন দায়িত্ববোধ আমার ভেতরে জন্ম নিল। প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক বিধিনিষেধের বালাই ঘুঁচে গেল চিরদিনের জন্য।
এই বিচিত্র সুখের অভিজ্ঞতা আমাকে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলে (ইউএনএফপিএ) কাজ করতে আগ্রহী করে তোলে। জাতিসংঘের অন্যতম এই অঙ্গসংগঠন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, বাল্যবিবাহসহ অন্য ক্ষতিকর প্রথাগুলো বিলোপ ও মোকাবিলার লক্ষ্যে কাজ করছে। দুনিয়ার তাবৎ পুরুষকুলের প্রতি, সব বাবা, ভাই আর সঙ্গীর প্রতি তাই আহ্বান জানাই আমাদের সঙ্গে এই মিশনে অংশ নেওয়ার।
চলুন, নিজেদের প্রকৃত সত্তাকে মুক্ত করার প্রক্রিয়ায় শামিল হই, নিজেকে নতুনভাবে ভাবি এবং গড়ে পিটে তোলা শুরু করি। আমাদের চিন্তা ও মানসিকতা, যাকে বলে ‘অপারেটিং সিস্টেম’, সেই সিস্টেমটাই চলুন পাল্টে দিই, নতুনভাবে ডিজাইন করি।
নতুন এই লড়াই হবে আমাদের বন্দিত্বের হোতা যত সব অচল প্রথা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কারণ, এসব অচল আচরণের ভুক্তভোগী নারী-পুরুষ-শিশু সবাই।
সময় এসেছে নতুন যুগের নতুন এক পুরুষত্বের ধারণাকে গ্রহণ করার। পুরুষ হবে সম্মানের পাত্র—অন্নদাতা নয় বরং নারী ও মেয়েদের সম্মান ও ইচ্ছাকে সমান সম্মান দেখানোর মাধ্যমে। পুরুষ হবে কর্তৃত্বপূর্ণ—অন্যকে দমন করার মাধ্যমে নয়, বরং নারী-পুরুষ সমতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে অগ্রণী শক্তি হিসেবে। পুরুষ হবে শক্তিশালী—অন্যের মতামতকে উড়িয়ে না দিয়ে বরং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা আর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মাধ্যমে।
কারণ, নারীদের পীড়ন, বৈষম্য আর সহিংসতা থেকে মুক্ত করতে পারলেই কেবল পুরুষেরা প্রকৃত মুক্তির স্বাদ পাবে।
মাসাকি ওয়াতাবে ডেপুটি রিপ্রেজেনটেটিভ, ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ।
উন্নয়ন সহযোগিতা এবং মানবিক কর্মকাণ্ডে ২৫ বছরের বেশি আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে স্নাতকোত্তর (সোশ্যাল পলিসি অ্যান্ড প্ল্যানিং ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিজ) এবং ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান থেকে স্নাতক (পলিটিক্যাল সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।