২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছিল, তখন বেশির ভাগ সামরিক বিশ্লেষক আশা করেছিলেন, দিনকয়েকের মধ্যে কিয়েভের পতন ঘটবে। কিন্তু এ যুদ্ধ এক বছর পেরিয়েছে এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বাহিনী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পারসহ অনেকে এখন বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, যুদ্ধ কি তাহলে অচলাবস্থার মধ্যে গিয়ে পড়ল।
ইউএস স্পেশাল ফোর্সেসের একজন সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে আমার বিবেচনায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন পর্যন্ত অচলাবস্থার খুব কাছে পৌঁছায়নি। অস্ট্রেলিয়ান সাবেক জেনারেল মিক রায়ানের সঙ্গে আমি একমত যে ‘সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাইরের দেশগুলোর সহায়তায় এ যুদ্ধ আরও দীর্ঘদিন ধরে চলবে। মাঝেমধ্যে জোয়ার উঠবে, আবার মাঝেমধ্যে ভাটার টানও পড়বে।’
ইউক্রেন যুদ্ধে এমন অনেক কিছু ঘটবে, যা আগে ঘটেনি।
অচলাবস্থা নিয়ে আবছায়া
২০২২ সালে শরতের শেষে ইউক্রেন যে ধরনের আক্রমণাত্মক যুদ্ধকৌশল নিয়েছিল, সে ধরনের আক্রমণে যেতে হলে সময় যেমন দরকার, আবার নতুন পরিকল্পনাও দরকার।
পশ্চিমাদের সামরিক সহায়তা, বিশেষ করে নতুন সামরিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এ ধরনের পাল্টা-আক্রমণের পরিকল্পনা সাজাতে আরও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে।
আবার রাশিয়া সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমি হারিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে তাদের রিজার্ভ বাহিনী থেকে নতুন করে নিয়োগ এবং পুরোপুরি ভেঙে পড়া লজিস্টিকব্যবস্থা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়া বড় আকারের আক্রমণাত্মক অভিযানের ক্ষেত্রে পরিকল্পনাহীনতার পরিচয় দিয়ে আসছে।
শীতকালে দুই পক্ষই যে ধীরে চলো নীতিতে এগিয়েছে এর কারণ হতে পারে, ভবিষ্যতে বড় ধরনের আক্রমণ পরিচালনার জন্য তারা সামরিক রসদ জোগাড়ের পাশাপাশি নতুন প্রস্তুতিও নিচ্ছে। যাহোক, যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে এসে আমরা এমন সব ঘটনাপ্রবাহ দেখতে চলেছি, যা প্রথম বছরে ঘটেনি। এই যুদ্ধের প্রথম বছরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে ছয়টি শিক্ষা বেরিয়ে এসেছে। এ সব শিক্ষা থেকে ধারণা করা যায় এ যুদ্ধের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
২০২০ সালে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্য সংঘটিত নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করে ট্যাংক অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অনেক সমর বিশ্লেষকের প্রশ্ন তাই যুদ্ধে ট্যাংকের দিন কি ফুরিয়ে এসেছে? ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ট্যাংকবহর একইভাবে বিধ্বস্ত করেছিল। কিন্তু দুটি যুদ্ধের ক্ষেত্রে ট্যাংক অকার্যকর হওয়ার পেছনে ট্যাংক দায়ী নয়, বাজে প্রশিক্ষণ ও অদক্ষ লোকের নিয়োগই এর কারণ।
এক. ইউরোপে যুদ্ধের ‘মৃত্যু’ এখনো ঘটেনি
২০০৮ সালে জর্জিয়াতে রাশিয়া আগ্রাসন চালায়। ২০১৪ সালে অবৈধভাবে ক্রিমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় মস্কো। ওই বছরই ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সরাসরি সমর্থন দেয় রাশিয়া। এ তিন ঘটনাতে মনে না হলেও ইউক্রেনে গত বছর রাশিয়া যে আগ্রাসন শুরু করেছে তাতে স্পষ্ট যে ২০২৩ সালে এসেও ইউরোপ মহাদেশে যুদ্ধ একটি বাস্তবতা।
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোকে অচল বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আগ্রাসন শুরুর পরে জোটটিই শক্তিশালী হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মতো নিরপেক্ষ দেশগুলোও জোটটি শুরুর ৭০ বছর পর এসে সদস্য হওয়ার আবেদন করছে।
দুই. আগ্রাসন ঠেকাতে রাশিয়াকে বাধা দেওয়া যায়নি
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেন আগ্রাসন থেকে কীভাবে সরিয়ে আনা যাবে, সেটা জানা বেশ কঠিন।
আমার দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট ইউক্রেন ও ক্রিমিয়াতে রাশিয়ার আগের আগ্রাসন থামাতে যথার্থ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতা ছিল জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের ব্যর্থতা। জর্জিয়ায় আগ্রাসন ও ক্রিমিয়া অন্তর্ভুক্ত করার পর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, তা অনেকটা বাহুতে হালকা করে চাপড়ে দেওয়ার মতো একটা ব্যাপার।
এবারে আগ্রাসন শুরুর আগে মাসের পর মাস ধরে রাশিয়া যখন ইউক্রেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ করছিল, এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো শাস্তি দেওয়ার হুমকি দেওয়া ছাড়া কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। কিন্তু সেসব হুমকি পুতিন উপেক্ষা করেছেন।
আগ্রাসন যখন আসন্ন হয়ে উঠল, এ সময়ে রাশিয়াকে নিবৃত্ত করার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা না চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বরং দূতাবাস বন্ধ করে ও কূটনীতিকদের সরিয়ে আগ্রাসনের সবুজ সংকেত দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুলনা দেওয়া যাক। ফ্রান্সে জার্মান নাৎসিরা যখন আগ্রাসন চালাতে উদ্যত হয়, তখনো যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস থেকে দূতাবাস বন্ধ করতে চায়নি।
তিন. সামরিক শক্তি শুধু সমরাস্ত্র ও সেনাবলের বিষয় নয়
সংঘাত যখন শুরু হয়, তখন কাগজে-কলমে রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর সামরিক শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের পরই তাদের অবস্থান। সামরিক শক্তি বিবেচনায় ইউক্রেন বিশ্বে ২২তম, এ হিসাবে রাশিয়া ইউক্রেনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি সুবিধা পাওয়ার কথা।
যদিও বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা কঠিন, কিন্তু এই যুদ্ধ থেকে দেখা যাচ্ছে যে মতবাদ, প্রশিক্ষণ, নেতৃত্ব ও নৈতিক জোর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে সোভিয়েত আমলের সেনাবাহিনী থেকে পশ্চিমা ধাপের সেনাবাহিনীতে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। এ যুদ্ধে তারই সুফল তারা পাচ্ছে।
চার. কিন্তু যন্ত্রই ব্যবধান গড়ে দিতে পারে
ইউক্রেনের জনগণের প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে সেটা সত্যি। কিন্তু সঠিক ও পর্যাপ্ত যুদ্ধ অস্ত্র, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি না থাকলে প্রথাগত যুদ্ধে তারা অনেক আগেই হেরে যেত। তখন হয়তো তাদের দেশজুড়ে গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করতে হতো।
ইউক্রেনের কাছে এখন হিমার্স রকেটব্যবস্থা, পদাতিক যুদ্ধের উপযোগী যান, ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান দেওয়ার আলোচনা সবখানেই চলছে। কিন্তু রাশিয়ার তুলনায় অনেক ছোট সামরিক বাহিনী হওয়ায় ইউক্রেনের সব ধরনের সামরিক সহায়তা প্রয়োজন।
ট্যাংক দিয়ে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সাজালেই হবে না, সেগুলোর জন্য পর্যাপ্ত গোলাবারুদের জোগানও দিতে হবে। কেননা, সেগুলো উৎপাদনের সক্ষমতা ইউক্রেনের নেই। দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের সক্ষমতা যাতে গড়ে ওঠে, সে জন্য আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত গোলাবারুদের জোগান দিতে হবে ইউক্রেনকে।
পাঁচ. ট্যাংকগুলো এখনো জাদুঘরে পাঠানোর সময় হয়নি
২০২০ সালে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্য সংঘটিত নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করে ট্যাংক অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অনেক সমর বিশ্লেষকের প্রশ্ন তাই যুদ্ধে ট্যাংকের দিন কি ফুরিয়ে এসেছে? ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ট্যাংকবহর একইভাবে বিধ্বস্ত করেছিল।
কিন্তু দুটি যুদ্ধের ক্ষেত্রে ট্যাংক অকার্যকর হওয়ার পেছনে ট্যাংক দায়ী নয়, বাজে প্রশিক্ষণ ও অদক্ষ লোকের নিয়োগই এর কারণ।
সামরিক কৌশলের দিক থেকে যুদ্ধে এখনো ট্যাংকের ভূমিকা রয়েছে। ইউক্রেনীয়রা প্রমাণ করেছেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক যথাযথভাবে ব্যবহার করা হলে সেটা কতটা কার্যকর হতে পারে।
ছয়: যুদ্ধ শহরাঞ্চলে সংঘটিত হচ্ছে
সামরিক বাহিনী সব সময়ই শহরাঞ্চলের যুদ্ধ এড়াতে চায়। সেটা অবশ্যই সঠিক।
তর্কাতীতভাবে সত্য যে শহরাঞ্চলে যুদ্ধের পরিবেশের ক্ষেত্রে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ আছে। এ ধরনের যুদ্ধ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিষ্ঠুর। ইউক্রেন যুদ্ধে এই বাস্তবতা আমরা দেখেছি। কিন্তু শহরাঞ্চলের যুদ্ধ এড়ানোও সম্ভব নয়। ইউক্রেনে শহরাঞ্চলে যুদ্ধের যে ব্যাপকতা তাতে করে বলা যায় সামরিক বাহিনীগুলো এখনো এ ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়।
লিয়াম কলিন্স প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মডার্ন ওয়্যার ইনস্টিটিউট, ইউনাইটেড স্টেটস মিলিটারি একাডেমি ওয়েস্ট পয়েন্ট
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত