অতি জরুরি পরিস্থিতিতে কি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর? এমন একটা আলোচনা উঠেছিল করোনা মহামারির শুরুর দিকে। যদিও কর্তৃত্ববাদের বিপরীতে গণতন্ত্র কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনগণের জন্য কল্যাণকর আবার গণতন্ত্রের বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার সুবিধা কী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের আলোচনা হয়।
একটা ভয়ংকর মহামারিতে যখন বড় পর্যায়ে লকডাউনের মতো অনেক কঠোর সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন মানুষ সেটা মেনে নিতে চায় না। কারণ, এসব পদক্ষেপ মানুষের জীবন-জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নাগরিকদের ক্ষোভ উষ্মা প্রকাশের অবারিত সুযোগ থাকে। তাঁরা প্রকাশও করেন। পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার শুরুর সময়টার পরে লকডাউন-বিরোধী নানা রকম বিক্ষোভ-প্রতিবাদের তথ্য আমাদের সামনে নিয়মিতভাবেই এসেছে। অথচ এ রকম সময়ে চীন যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময়ে, যত দিন, যেভাবে ইচ্ছা লকডাউন দিতে পেরেছে। মানুষ সেটা নিয়ে ভেতরে অসন্তুষ্ট থাকলেও কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। এমনকি তাদের অসন্তোষ কতটা ছিল, সেটা প্রকাশ করার জায়গাও যেহেতু খুব বেশি নেই, তাই সেটা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানতে পারেনি বিশ্ববাসী।
কোভিডের সময় আরেকটা সংকট দেখা দিয়েছিল টিকা দেওয়া নিয়ে। খুব কম সময়ে কোভিডের টিকা তৈরি হওয়ার কারণে এই টিকার প্রতি অনেকের অনাস্থা ছিল। এ ছাড়া সংস্কারের কারণে অনেকেরই টিকা নেওয়ার ব্যাপারে অনীহা ছিল। পশ্চিমা অনেক দেশ তার নাগরিকদের অনেককে টিকা দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে। নানা সেবা আপনার ক্ষেত্রে টিকার সনদের অত্যাবশ্যকতা তৈরি করে সবাইকে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতিও তারা করেনি। অথচ চীন দৈনন্দিন জীবনযাপনের আটপৌরে সব ব্যাপারে কোভিড ভ্যাকসিনের সার্টিফিকেট তো চেয়েছেই নিয়মিতভাবে, চেয়েছে করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরীক্ষার ফল। বলা বাহুল্য, এ রকম কিছু পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে হলে চরম গণবিক্ষোভের মুখে সরকার চরম বেকায়দায় পড়ে যেত।
এই প্রসঙ্গে আলোচনায় এসেছে নাগরিকদের ওপর চীনের অকল্পনীয় নজরদারির সক্ষমতার কথাও। জর্জ অরওয়েল-এর নাইন্টিন এইটি ফোর উপন্যাসে বর্ণিত একটা আদর্শ ‘অরওয়েলের নজরদারি রাষ্ট্র’ হওয়ার পথে ভীষণ এগিয়ে যাওয়া চীনের পক্ষে খুবই সম্ভব কোভিডসহ তার যেকোনো নির্দেশনা অমান্যকারীকে খুব সহজে শনাক্ত করা এবং তাকে শাস্তির আওতায় আনা।
আমরা স্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছি চীনের কর্তৃত্ববাদ কোভিডের মতো অতি জরুরি পরিস্থিতিকে ভালোভাবে মোকাবিলা তো করেইনি বরং উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর তুলনায় অনেক খারাপ করেছে। কোভিডের শুরুর দিকের সেই আলাপের একটা সিদ্ধান্ত আমরা পেয়ে গেলাম। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা কোনোভাবেই কোনো পরিস্থিতিতে জনগণের জন্য কল্যাণকর নয়।
শুধু সেটাই নয়, কোভিডের শুরুর দিকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চীনের টিকা আবিষ্কার করাটাও অনেকের কাছে বাহবা পেয়েছিল। অনেক দেশে টিকা সরবরাহ করে টিকা কূটনীতিতে চীন অনেক এগিয়েও ছিল। টিকা আবিষ্কার ও বাজারে নিয়ে আসতে পারার পেছনেও চীনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভূমিকা দেখা হচ্ছিল। উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যতগুলো ধাপ পার হয়ে আসতে হয়, চীনের ক্ষেত্রে সেগুলোকে খুব সহজে কোনো ক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে আবার কোনো ক্ষেত্রে অতি সংক্ষিপ্ত করা খুব সহজ ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে চীনের কোভিড পরিস্থিতি কি অন্তত এই ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদের সাফল্যের জয়গান গায়?
শূন্য কোভিড নীতিতে থাকতে থাকতে চীনের জনগণের এতটাই নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল যে চীনের বিভিন্ন শহরে জনবিক্ষোভ শুরু হয়, যা চীনের মতো দেশে একেবারে অকল্পনীয়। পরিস্থিতি এতটা খারাপের দিকে গেছে যে মূলত যার একক সিদ্ধান্তে এই নীতি পরিচালিত হয়েছে, সেই চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এই নীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই নীতি থেকে বেরোনোর পর চীনে কোভিডের বিস্ফোরণ হয়েছে।
সমস্যা হচ্ছে চীনে কোভিডের বর্তমান পরিস্থিতি পুরো সঠিকভাবে দূরেই থাকুক, মোটামুটিভাবেও বোঝা প্রায় অসম্ভব। আমরা জানি, চীন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া কঠিন। আর সঠিক তথ্য পাওয়া তো আরও বেশি কঠিন। আর কোনো তথ্য যদি চীনের ক্ষমতাসীনদের প্রতি কোনো রকম নেতিবাচক বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে সে তথ্য পাওয়া অসম্ভব প্রায়।
চীনে করোনায় কত মানুষ মারা গেছে, এই তথ্যের জন্য কেউ যদি খোঁজখবর করতে ওয়ার্ল্ডোমিটারে যান, তাহলে সেখানকার গ্রাফটির দিকে তাকালে নিশ্চয়ই অবাক হবেন। ২০২০ সালের ২২ এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৬৩২, যা দুই বছর পরে (২০ এপ্রিল, ২০২২) দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৫৫ তে। অর্থাৎ সরকারি ভাষ্যমতে, দুই বছরে চীনে কোভিডে মারা গেছেন মাত্র ২৩ জন। এরপর গ্রাফটি খুব খাড়া হয়ে ওপরে উঠতে দেখা যায় এবং এই বছরের মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ ৫ হাজার ২০০ অতিক্রম করে। এরপর গ্রাফটি আবার একেবারে ভূমির সমান্তরালভাবে চলতে থাকে। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য লাগবে জেনে জিরো কোভিড নীতি তুলে নিয়ে অনেক রকম বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর যখন কোভিডের বিস্ফোরণ হয়েছে দেশটিতে, তখনো মৃত্যুর সংখ্যার গ্রাফ চলছে সমান্তরালেই। একটি ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা নানা বিষয় হিসাব করে দেখাচ্ছে চীনে দৈনিক মৃতের সংখ্যা ৯ হাজারের মতো।
যাহোক, আমরা হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং সৎকারের স্থানগুলোতে মৃতদেহের সারি দেখে বুঝতে পারি প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন। এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, চীন খুব দ্রুত দুটি কোভিডের টিকা (সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম) বের করে নিজে তো নিয়েছেই, পৃথিবীর বহু দেশকে দিয়েছে, সেগুলো আদৌ কতটা কার্যকর।
আসলে কোভিডের সময়ই চীনা টিকার কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। দুই ডোজ চীনা টিকা নিয়েও শত শত স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হচ্ছেন, এমন খবর প্রকাশিত হয়েছিল থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায়। আক্রান্ত কর্মীদের মধ্যে ২ জন থাই ও ৩০ জন ইন্দোনেশীয় স্বাস্থ্যকর্মী মারাও গিয়েছিলেন। এর ফলে দেশ দুটি তাদের টিকা দেওয়ার পদ্ধতিতে সংশোধন এনেছিল। থাইল্যান্ডে দুই ডোজ চীনা টিকার বদলে এক ডোজ চীনা ও আরেক ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা মিশ্র পদ্ধতিতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী দুই ডোজ চীনা টিকা পেয়েছিলেন, তাঁদের বুস্টার শট হিসেবে মডার্নার টিকা দেওয়া হবে।
এই অঞ্চলের আরেক দেশ মালয়েশিয়াও চীনা টিকার বর্তমান চালান শেষ হওয়ায় ফাইজারের টিকার মাধ্যমে টিকাদান শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনেও চীনা টিকা দেওয়ার পর সেটা নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ নাগরিকদের ফাইজারের টিকা দিয়ে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছিল। এর অনেক আগে সৌদি আরব চীনা টিকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।
চীন সনাতন পদ্ধতিতে টিকা বানিয়েছিল। রাসায়নিক পদ্ধতিতে কোভিড ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে সেটা দিয়ে টিকা তৈরি করা হয়েছিল। এর চেয়ে ফাইজার কিংবা মডার্নার তৈরি করা টিকা (এম আরএনএ) প্রযুক্তিগতভাবে আরও অনেক উন্নত এবং বেশি কার্যকর। এতে পুরো ভাইরাস নয় বরং তার জেনেটিক কোড তৈরি করে সেটা দিয়ে টিকা তৈরি করা হয়। কিন্তু এই দুই টিকার সঙ্গে তুলনা না করেও চীনা টিকাকে তুলনা করা যায় অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সঙ্গে, যা একই রকম সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছিল। এই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বে কোনো অভিযোগ আসেনি।
চীন যেমন ধরনের একটা সমাজব্যবস্থা তৈরি করেছে, তাতে অন্তত টিকাদানের ক্ষেত্রে তাদের খুব বড় সাফল্য থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেখানেও আছে চরম ব্যর্থতা।
কোভিডের এই পর্যায়ে এসেও ষাটোর্ধ্ব মানুষের দুই ডোজ টিকা দেওয়ার হার ৮০ শতাংশের কিছু বেশি। আর বুস্টার ডোজ হিসাব করতে গেলে এই সংখ্যা অনেক কম। চীনের আর সব ডেটার মতো এই ডেটাও বিশ্বাসযোগ্য না। কিন্তু একে সঠিক ধরে নিলেও এই হার উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। একে তো টিকার কার্যকারিতার হার খুব কম, আবার সেই টিকা ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা অনেক পিছিয়ে। অথচ কোভিড নিয়ন্ত্রণের নামে কিছুদিন আগে পর্যন্তও লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে জনগণের জীবনে চরম সংকট যেমন তৈরি করেছে, তেমনি অর্থনীতিতেও গভীর সংকট তৈরি করেছে চীনা সরকার।
আমরা স্পষ্টভাবেই দেখতে পাচ্ছি চীনের কর্তৃত্ববাদ কোভিডের মতো অতি জরুরি পরিস্থিতিকে ভালোভাবে মোকাবিলা তো করেইনি বরং উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর তুলনায় অনেক খারাপ করেছে। কোভিডের শুরুর দিকের সেই আলাপের একটা সিদ্ধান্ত আমরা পেয়ে গেলাম। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা কোনোভাবেই কোনো পরিস্থিতিতে জনগণের জন্য কল্যাণকর নয়।
জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষক