প্রতিবছর ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস পালন করা হয়। স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ২০০৭ সাল থেকে এ দিবস পালন করা হয়ে আসছে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে একটি জোট বা মোর্চার মাধ্যমে। এ বছর বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘বিকল্পের ক্ষমতা’, অর্থাৎ জন্মনিরোধককে বেছে নেওয়া বা পছন্দের মধ্য দিয়ে প্রজননস্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রণ, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ক্ষমতায়িত হয়ে থাকেন।
এ প্রতিপাদ্য শুধু জন্মনিরোধকের ব্যবহার নয়, বরং একজন ব্যক্তি বা দম্পতির কাছে জন্মনিরোধকের বেছে নেওয়া বা পছন্দের সুযোগদান, ব্যক্তির স্বাধীনতার সম্প্রসারণ, তথ্যের সরবরাহের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রজননস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
জন্মনিরোধের ব্যবহার শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ প্রতিরোধেই মুখ্য ভূমিকা পালন করে না, একই সঙ্গে যৌনবাহিত রোগ দম্পতি বা সঙ্গীর এবং মা ও নবজাত শিশুকে সংক্রমণের ক্ষেত্রে তা হ্রাস করে। পরোক্ষভাবে অনিরাপদ গর্ভপাতকে হ্রাস করে। জন্মনিয়ন্ত্রণ না করলে বা পরিকল্পনা অপরিকল্পিত হলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, গর্ভপাত, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, যৌনবাহিত রোগসহ প্রজননস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব বা ঝুঁকি বাড়াবে।
জন্মনিরোধ নিয়ে জ্ঞান থাকলেও একাধিক কারণে এর যথাযথ ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা থেকে যায়। পদ্ধতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে দুশ্চিন্তা, নিম্নমানের সেবা সরবরাহ, জন্মনিরোধের সীমিত প্রাপ্যতা, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকভাবে বিরোধিতা, জেন্ডারভিত্তিক বাধা ইত্যাদিই এ ক্ষেত্রে মুখ্য।
দেশ-কাল-সমাজভেদে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কখনো কখনো ভুল ধারণা লক্ষ করা যায়। যেমন পিল খেলে শরীরের ওজন বেড়ে যাবে, মাথার চুল পড়ে যাবে, ক্যানসার হবে, স্বাভাবিক প্রজননক্ষমতাকে হ্রাস করবে, বয়স্ক মানুষের জন্মনিরোধ ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই, কনডম ও পিলের বাইরে আর কোনো জন্মনিরোধ নেই-এমন রকম বহুবিধ ধারণা থাকতে পারে।
আবার ‘অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকলে জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার ছোট রাখার কোনো প্রয়োজন নেই’-এমন ধারণাও ভুল। এ রকম ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, অধিক সন্তান ধারণ বা পরিবার ছোট না রাখা পরিকল্পিত সুন্দর জীবন ও ভবিষ্যৎ নির্মাণে বাধা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও দম্পতিকে সব ভুল ধারণা বা ভুল বিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে হবে এবং বিজ্ঞানসম্মত গবেষণালব্ধ ফলাফলে আস্থা রাখতে হবে। পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে একজন দম্পতি যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সর্বমোট কয়টি সন্তান নেবেন, কত দিনের বিরতি নেবেন, সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে জন্মনিয়ন্ত্রণে পছন্দসই কী কী পদ্ধতি স্বেচ্ছায় ব্যবহার করবেন ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ হচ্ছে এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দম্পতি বা স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে আলোচনা করে পরিকল্পিতভাবে পরিবার গঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই পরিবার পরিকল্পনা। যেকোনো পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠন। এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবারের সার্বিক মঙ্গল ও উন্নতিসাধনই পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য।
পরিবার পরিকল্পনায় দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের সাফল্য থাকলেও (১৯৭৫ সালে জন্মনিরোধ ব্যবহারের হার ছিল ৮ শতাংশ, ১৯৯৩-৯৪ সালে ৪৪.৬ শতাংশ, ২০১১ সালে পৌঁছেছে ৬১.২ শতাংশ) ২০১১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত একধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রয়েছে বা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০১২, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০), পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২১) অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখনো জন্মনিরোধ ব্যবহারের কাঙ্ক্ষিত হার অর্জন করতে পারেনি। নীতি ও পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া, উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা, অপর্যাপ্ত সম্পদ ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি, অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়ে ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অর্জনে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট কোনো কৌশলপত্র ছিল না। অতি সম্প্রতি সরকার এ ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা কৌশলপত্র তৈরি ও বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি হালনাগাদের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তা হলো পরিবার পরিকল্পনার উচ্চ অপূর্ণ চাহিদা, কিশোরী মাতৃত্ব, জন্মনিরোধ ব্যবহারের হারে স্থিতাবস্থা, প্রসবপরবর্তী পরিকল্পনায় কম প্রবেশগম্যতা, স্বল্পমেয়াদি উচ্চ জন্মনিরোধক বন্ধ, পদ্ধতি ব্যবহারে অসমতা বা ভিন্নতা, গুণগত নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদান, শহরে বস্তিসহ দেশে বঞ্চিত এলাকায় ও জনগোষ্ঠীতে সেবা নিশ্চিত করা, জলবায়ুর পরিবর্তন, পুরুষের অংশগ্রহণ, অপর্যাপ্ত জনবল, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়, এনজিও, পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারত্ব, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন-গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করা।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৩.৭ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা, তথ্য, শিক্ষাসহ যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য পরিচর্যা সেবায় সর্বজনীন অধিকার নিশ্চিত করা এবং প্রজননস্বাস্থ্যকে জাতীয় কৌশল ও কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনায় বর্তমানের অপূর্ণ চাহিদাকে (১০ শতাংশ) আইসিপিডি+ ২৫ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিবার পরিকল্পনা হচ্ছে মানবাধিকার। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘিত হলে মানবাধিকার বাধাগ্রস্ত হবে। শিক্ষা ও শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ, সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। দেশের প্রথম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন) অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে পরিবার পরিকল্পনা যথাযথভাবে গ্রহণ করলে উপকৃত হবেন দম্পতি, পরিবার, সমাজ তথা পুরো রাষ্ট্র।
এ কারণে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাস্তবতাকে সামনে রেখে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো বা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হলো পরিকল্পনা। আর একটি পরিবারের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নতির লক্ষ্যে একটি দম্পতি ও পরিবারের অন্য সদস্যরা সচেতনভাবে চিন্তাভাবনা করে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, সেটিই হবে সঠিক ‘পরিবার পরিকল্পনা’। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস ২০২৩ সফল হোক। আমাদের মধ্যে থাকা প্রজননস্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ-বিষয়ক সব ভুল ধারণার অবসান ঘটুক।
ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম অধ্যাপক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]