লন্ডন থেকে বার্লিনে যাচ্ছিলাম। অফিসের কাজে। দেড় ঘণ্টার এই ফ্লাইটে প্রায় সময়ই পাশের যাত্রীকে বিলেতি আচার মেনে ‘হ্যালো’ বলে কম্পিউটারে মুখ বুজে কাজ করি। সেদিন হঠাৎ পাশের যাত্রী প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি চকলেট খাও? খেলে বিমান থেকে দেওয়া আমার এই চকলেটটি তুমি নিতে পারো।’ আমি নিজে চকলেট না খেলেও বেশ চমকে গেলাম। ভালো লাগার চমক।
মাত্র কয়েক শব্দের ছোট্ট একটি প্রশ্ন। কিন্তু আলাপের এই আহ্বান আমি ফেলতে পারলাম না। দেড় ঘণ্টার এই বিমানযাত্রায় জানতে পারলাম ক্রিসের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বার্লিনে আসার গল্প। দেড় দশক আগে কাজের প্রয়োজনে বার্লিনে প্রথম আসা। ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির টানে পড়ে বার্লিনে থিতু হওয়া। ক্রিস এখন নিজেই কোম্পানি খুলেছে। বাচ্চাদের পড়া শেখানোর সফটওয়্যার বানানোর। বার্লিনে কফি শপে এক বিকেলে আবারও বসার প্রতিশ্রুতিতে আলাপটা শেষ হলো।
প্রশ্ন দিয়েই তো যেকোনো আলাপের শুরু। আলাপ থেকে সম্পর্ক। জানার আগ্রহ আমাদের মজ্জাগত। সভ্যতার শুরুতে যখন ভাষার আবিষ্কার হলো, প্রশ্ন করার ধরনের ক্রমাগত বিবর্তন হতে শুরু করল। আদিম মানুষেরা প্রশ্ন আর উত্তরের মাধ্যমেই বিপৎসংকুল পরিবেশে টিকে থাকা, খাবার জোগানোর কৌশল একে অপরের কাছ থেকে জানতেন।
নৃবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার একটা অন্যতম কারণ আদিম মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকা। গোষ্ঠীগুলোর সমৃদ্ধির একটা অন্যতম নিরূপক ছিল তাদের নিজেদের মধ্যে বন্ধন। বছরের পর বছর গোষ্ঠীর সামগ্রিক জ্ঞান প্রশ্ন আর উত্তরের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে। দৃঢ় হয়েছে বন্ধন। তৈরি হয়েছে সভ্যতা।
নতুন কিছু জানার শুরুটাই তো প্রশ্ন দিয়ে।
প্রশ্ন করা, বিশেষ করে ভালো প্রশ্ন করা অতি গুরুত্বপূর্ণ একধরনের স্কিল। যা কিনা সহজাত নয় অর্থাৎ শেখা যায়। গ্রিক দার্শনিকেরা প্রশ্ন করার প্রক্রিয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস প্রায় সময়েই তার শিষ্যদের একের পর এক প্রশ্ন করতেন। এভাবেই ছাত্রদের উত্তরের মাধ্যমে বেরিয়ে আসত জটিল সব দার্শনিক তত্ত্ব। অঙ্ক না জানা এক ছোট্ট বালককে শুধু প্রশ্ন করে করেই একটি বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল কীভাবে দ্বিগুণ করা যায় সেই সমাধান তিনি বের করেছিলেন।
অনেক দেশেই শিশুদের স্কুলে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু ভালো প্রশ্ন করার পদ্ধতি খুব একটা যে শেখানো হয় তেমনটি নয়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে শিশুদের প্রশ্ন করাকে উৎসাহিত করলে তাদের বুদ্ধিমত্তা, ভাষার প্রতি দখল, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, মনোবল এবং জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে মা–বাবারা সন্তানকে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করেন, সন্তানের প্রশ্নগুলোর জবাব দেন সেই সন্তান এবং বাবা-মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য, চিন্তা করার ক্ষমতা এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটে।
মনোযোগ অর্থনীতির এই যুগে আমাদের সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে হাতের মুঠোফোন। শিশুদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় কোথায় আমাদের হাতে? প্রশ্নের জবাব না পেলে শিশুরা প্রশ্ন করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আমাদের পারিবারিক বন্ধুদের মধ্যে আমার সন্তানদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো যারা ওদের সঙ্গে দেখা হলেই প্রশ্নের মাধ্যমে আলাপে জড়িয়ে পড়েন এবং ওদের প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়।
সাংবাদিকতা, চিকিৎসা বা আইনের মতো পেশাতে প্রশ্ন করা রীতিমতো শেখানো হয়ে থাকে। এর বাইরেও অধিকাংশ পেশাতে প্রশ্ন করা দৈনন্দিন কাজের একটা বড় অংশ। অধিকাংশ জায়গাতেই এ বিষয়ে তেমন কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। কাজের জায়গাতে ভালো প্রশ্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নের গভীরতা দেখে অনায়াসে যেকোনো ব্যক্তির অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের ব্যাপ্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
একইভাবে বোকা বোকা বা অকারণে সব ব্যাপারে প্রশ্ন করা সহকর্মীকে আমরা কেউই ভুলি না। যেকোনো ভালো প্রশ্নের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো প্রশ্নের মাধ্যমে আপনাকে বোঝাতে হবে ওই আলাপের জন্য আপনি পুরোপুরি তৈরি। কিছুটা পড়াশোনা করেছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানা। ধরুন, কোম্পানিতে আপনার নতুন ম্যানেজার যোগ দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে প্রথম মিটিং। তাকে খুশি করাই আপনার লক্ষ্য। ‘আপনি আগে কোন কোন কোম্পানিতে কাজ করেছেন?’
এই প্রশ্নটি না করে আপনি যদি এভাবে আলাপ শুরু করেন, ‘আপনি আমাদের সেক্টরের নামকরা কোম্পানিতে কাজ করেছেন। আপনার অনেক অভিজ্ঞতা। আমাদের জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?’ এই প্রশ্নের মাধ্যমে আপনি বুঝিয়ে দিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আপনি জ্ঞাত এবং শ্রদ্ধাশীল।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো ভালো প্রশ্ন কখনোই নিজের পাণ্ডিত্য আর অভিজ্ঞতা জাহির করে না। জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা সূক্ষ্মভাবেও প্রশ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব। কীভাবে? ধরুন, আপনি বিলেতি ডিগ্রিধারী নামকরা স্থপতি। পরিবেশবান্ধব একটি কারখানার নকশা করার জন্য আপনাকে ডাকা হয়েছে।
আলোচনাটা আপনি এভাবে শুরু করলেন, ‘বিলেতের সবচেয়ে দামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছি। এর আগে ৩০টি পরিবেশবান্ধব ভবন বানিয়েছি। বলুন আপনারা কী চান?’ আপনি এভাবেও করতে পারেন, ‘পরিবেশবান্ধব বেশ কিছু ভবন বানানোর অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। তা ছাড়া বিদেশে পড়ার কারণে পরিবেশবান্ধব কারখানা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলোর দিকনির্দেশনা সম্পর্কে আমি পরিচিত। এ ব্যাপারে আপনাদেরও নিশ্চয়ই কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। সেগুলো একটু বলবেন?’
ভালো প্রশ্নের আর একটা শর্ত হলো এর মাধ্যমে অন্যের মতামতকে ভাবিয়ে তুলতে হবে অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। অনেক দিন আগের কথা। স্টিভ জবস অ্যাপলের জন্য প্রধান নির্বাহী খুঁজছেন। অ্যাপল তখন একদমই নামকরা কোম্পানি নয়। তৎকালীন পেপসি কোলার প্রধান নির্বাহী ছিলেন জন স্কালি। জবস জন স্কালিকে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী পদে নিয়োগ দিতে চান। জন কিছুতেই রাজি নন। জবস ছাড়ার পাত্র নন। হাঁটতে হাঁটতে জনকে প্রশ্ন করলেন, ‘সারা জীবন চিনি দেওয়া জল বিক্রি করবে? না পৃথিবী বদলে দেওয়া পণ্য তৈরি করবে?’ জন স্কালি এরপর অ্যাপলের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেন।
আমরা পৃথিবী বদলাতে না পারলেও পাশের পরিচিত জনকে ‘কেমন আছেন?’ এই প্রশ্ন করা অব্যাহত রাখতে পারি।
ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]