ইলিশ রক্ষায় জেলেরা অরক্ষিত কেন?

আমাদের ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ পরিচয়ের পেছনের জোগানদাতা কৃষক ও জেলেদের আমরা কতখানি মূল্য-সম্মান দিই?ছবি: প্রথম আলো

কৃষির পাশাপাশি মাছ ধরা বা জেলে পেশা পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি পেশা। মাছ চাষ নয়, তাত্ত্বিক ভাষায় বলতে গেলে, ক্যাপচার ফিশারিজ বা উন্মুক্ত জলাধারে মাছ আহরণ প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত পেশার একটি। শুধু তা–ই নয়, এটি অন্যমত ঝুঁকিপূর্ণ পেশাও বটে।

দ্য পিউ চ্যারিটেবল ট্রাস্টের কমিশন করা ফিশ সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০২২ সালের বৈশ্বিক গবেষণায় অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। যদিও এই তথ্য কেবল মৃত্যুর রিপোর্ট হয়েছে, সেই সংখ্যার ভিত্তিতে পাওয়া। রিপোর্ট করা হয়নি, এমন মৃত্যুন সংখ্যা কত, তার খোঁজ আমরা রাখি না; কতটা ভাবি, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

একজন জেলে আসলে কতভাবে মারা যান? শীতের সময় রাতভর মাছ ধরবেন, জাল ফেলে নৌকায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন হয়তোবা ঘুমিয়ে গেছেন; এমন সময় মৃত্যুদূতসম জাহাজের আঘাতে জীবন গেল। ভোরবেলা মাছ ধরা অবস্থায় বার্জ উঠে যায় নৌকায়, এমন ঘটনায় প্রায়ই একাধিক জেলের জীবন যায়। ইলিশ মাছের খোপে শেষ বিকেলে জাল তুলছেন, হঠাৎ জলদস্যুর হামলায় মারা যান জেলেরা। বৈরী আবহাওয়ায় হারিয়ে যাওয়া, নিখোঁজ জেলেদের খোঁজ পাওয়া নিয়েও বিশেষ তোড়জোড় হয় না।  কতজন পঙ্গুত্ব বরণ করেন, তার খবর আমরা পাই না।

২০২৩ সালে মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়ে পেটের দায়ে মাছ ধরতে নদীতে নেমে নৌ পুলিশের গুলিতে মারা যান এক তরুণ জেলে। ওপরের কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়, একটু খেয়াল করলেই খবর মেলে, আজকাল হরহামেশাই জেলেরা প্রাণ হারান।

মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময় বাংলাদেশে মোট তিনবার—অক্টোবর-নভেম্বর ২২ দিন মা ইলিশ রক্ষা করার জন্য, মার্চ-এপ্রিল ২ মাস ইলিশের অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত ৬টি এলাকায় জাটকা বড় হতে দেওয়ার জন্য এবং মে-জুলাই ৬৫ দিন সাগরে প্রাকৃতিকভাবে মাছের জোগান বাড়ানোর জন্য।

এ ছাড়া নভেম্বর-জুন ৮ মাস ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জাটকা ধরা, বহন করা, বাজারজাতকরণ ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; অর্থাৎ এই ৮ মাস পরই ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৪৭ দিনই মাছ ধরা নিষেধ, একটা বছরের প্রায় ৪০ ভাগ সময় একজন জেলে মাছ ধরতে পারবেন না।

নিষিদ্ধের দুটি সময়ে সরকারি তরফে শুধু চাল বরাদ্দ দেওয়া আছে জেলেদের জন্য। কিন্তু শুধু চালে একজন জেলে তাঁর জাল গুছিয়ে রাখার পর নিজের জীবন ও পরিবার চালাতে পারেন কি না, সেই প্রশ্ন করার আগেই প্রশ্ন ওঠে, সব জেলেই কি চাল পান?

জেলেদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সরকার বরাদ্দ ৪০ কেজি চালের স্থানভেদে ১০-৩৫ কেজি চাল পান জেলেরা। সেটিও সবাই নন। শুধু যেসব জেলের জেলে কার্ড আছে, তাঁরাই পান। এই জেলে কার্ডও আবার সীমিত।

২০২৪ সালে কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভোলা, কক্সবাজার, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী—এই ৭ জেলায় রেজিস্টার্ড জেলে আছেন ৮ লাখের ওপরে, কিন্তু এই ৭ জেলায় জেলে কার্ড আছে ৭ লাখ জেলের। নারী জেলেরা এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে, খুব কম নারী জেলের কার্ড আছে। তার ওপর স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা অনেকেই আছেন জেলে নন, কিন্তু জেলে কার্ডধারী। সব মিলিয়ে এক চরম বঞ্চনার শিকার জেলেরা।

এর ওপরে আছে সারা বছরব্যাপী পুলিশি হয়রানি, যেখানে জেলেদের জীবন পর্যন্ত চলে যায়। চাঁদপুরের অসংখ্য জেলে অসংখ্যবার জানিয়েছেন, তাঁদের সারা বছরব্যাপী পুলিশকে চাঁদা দিয়ে নদীতে জাল ফেলতে হয়। কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত তথ্যে আরও পাওয়া যায়, সারা বছর নিম্ন আয় করা জেলেদের প্রায় ৬০ ভাগ নিষিদ্ধের সময়ে প্রায় কিছুই আয় করেন না, ঋণের দায় তখন এতই বেড়ে যায় যে একজন জেলের তাঁর আয়-উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলাফল মানসিক চাপ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়া।

বৈধ-অবৈধ জালের প্রশ্নে চাঁদপুরের রাজরাজেশ্বর ইউনয়নের একজন জেলে বলেই ফেলেন, ‘টাকা দিয়াই যদি নদীতে জাল ফেলা লাগে, তাহলে আমাদের বৈধ আর অবৈধ কী?’ প্রশ্নটা যুক্তিযুক্ত, আরেকটু ভাবলেই আরেকটি প্রশ্ন দাঁড়াবে, জাল ব্যবহার অবৈধ হলে এত অবৈধ জাল কোথা থেকে আসছে? কারেন্ট জাল, বিহুন্দি জাল, চায়না জালের মতো জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর জাল নিষিদ্ধ হলে জেলেরা এসব জাল কোথায় পান?

কয়েকবার নামকাওয়াস্তে জাল উৎপাদনের ফ্যাক্টরিতে পুলিশি অভিযান চালানো হয়, কিন্তু মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যান। জাল বানিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামান ফ্যাক্টরির মালিকেরা, সেই জাল ব্যবহার করে পুলিশের কাছে ধরা খান জেলে, জাল পোড়ানো হয়, টাকার বিনিময়ে ছেড়েও দেওয়া হয়, তাতে অধিকাংশ সময় মারধর, মামলা-হয়রানি যুক্ত হয়। টাকা কোনোভাবে জোগাড় করা জেলে সেই টাকা পাওনাদারকে ফেরত দিতে আবার নদীতে নামেন। জালের তো অনেক দাম, তার চেয়ে নিষিদ্ধ জালই সহজলভ্য, তাই কিনে আবার নদীতে নামেন। পরিবার না খেয়ে আছে, অনেক টাকা ঋণ হয়ে আছে, অনেক দায় একজন জেলের।

মাছ ধরার নিষিদ্ধের মৌসুমে মাছ ধরার আইনত জেল–জরিমানার সীমা ৫ হাজার টাকা বা ২ বছরের। তাতে কোথাও মারধর করা, হতাহত করা, চাঁদা নেওয়া, হয়রানি করা—এসবের উল্লেখ নেই। ২০২১ সালে চাঁদপুরের মোহনপুর ফাঁড়ির নৌ পুলিশের গুলিতে মারা যান তরুণ জেলে মাসুদ। গুলি করার পরও মাসুদ বেঁচে ছিলেন, তাঁর রক্তক্ষরণ বন্ধের কোনো উদ্যোগই নেয়নি নৌ পুলিশ। উল্টো তাঁদের নামেই পুলিশ পাল্টা মামলা দেয়। সেই মামলায় আজ অবধি মাসুদের পরিবারকে হাজিরা দিতে হয়। অথচ মোহনপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়িকে ৬ হাজার টাকা চাঁদা দিয়েই নদীতে নেমেছিলেন মাসুদ ও তাঁর সঙ্গের জেলেরা।

জেলেরা এত ঝুঁকি নিয়ে কেন তাহলে মাছ ধরবেন? আমাদের ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ পরিচয়ের পেছনের জোগানদাতা কৃষক ও জেলেদের আমরা কতখানি মূল্য-সম্মান দিই? কৃষককে অন্নদাতা হিসেবে সম্মান দিতে শেখানো হয়, কিন্তু “জাইল্লা” আমাদের কাছে গালি হিসেবে পরিচিত। জেলেদের প্রতি আমাদের এই চরম অবমাননাকর ব্যবহার কেন?

জেলেদের যখন গ্রেপ্তার করা হয়, সেই খবর বেশির ভাগই পুলিশের বরাতে সংবাদে আসে। ইলিশের সঙ্গে আমাদের আবেগ জড়িত, আমরাও বাহবা দিই এমনভাবে, যেন জেলেরা দেশের এই অমূল্য সম্পদ নষ্ট করছেন। অথচ প্রকৃত জেলেরা আমাদের থেকে অনেক ভালো করে জানেন মাছ সংরক্ষণের গুরুত্ব। যাঁরা ইলিশ ধরেন, তাঁদের কজন ইলিশ খেতে পারেন, তা আমরা খোঁজ নিই না।

সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই জেলেদের যে ‘ভিলেন’ হিসেবে তুলে ধরা হয়, তা আর কোনো পেশায় দেখা যায় না। আমার-আপনার যে জীবিকা, সেই জীবিকা থেকে আমাকে-আপনাকে প্রায় ৫ মাস সরিয়ে রাখা হয়, আমরা কীভাবে চলব? পেটের তাগিদে আমাদের যদি আবার নিজ নিজ পেশায় ফিরতে হয়, তখন আমাদেরই এভাবে ভিলেন রূপে চরিত্রায়িত করা হলে সেটা আমি-আপনি কীভাবে নেব? মাছ সংরক্ষণ অতি জরুরি। মাছ, বিশেষ করে ইলিশকে আমরা আমাদের ঐতিহ্যের ধারক বলে মনে করি।

কিন্তু মাছ সংরক্ষণের সব দায় কি শুধু জেলেদেরই? ক্ষমতার ধারায় যাঁর অবস্থান সবচেয়ে নিচে, তাঁদের রক্ষার দায় আমরা যাঁরা ক্ষমতার ধারার ওপরে আছি, তাঁদের ওপর বর্তায়। এ রকম প্রতিকূলতায়, এত বঞ্চনায় কোনো জেলে চান না​ তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম মাছ ধরাকে পেশা হিসেবে নিক। সত্যি সত্যি যদি এমন অবস্থা হয়, আমরা মাছে-ভাতে বাঙালির পরিবর্তে শুধু ভেতো বাঙালি হয়ে থাকব।

যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন থাকবে, জেলেদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার সব উপাদান যেন আইনকানুনে প্রতিফলিত হয়। আমরা জেলেদের প্রতি সুবিচার, সহমর্মিতা আর সম্মান চাই। নদী ও মৎস্য ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য জেলেদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। কেননা এ–সংক্রান্ত যেকোনো আইন ও নীতির প্রথম প্রভাব পড়ে জেলেদের ওপর। নিপীড়নের অন্তর্জালে জড়িয়ে থাকা এই জেলেদের সত্যিকারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে চাই সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

  • শান্তা সোহেলী বেসরকারি উন্নয়নকর্মী

    (লেখাটি লেখকের নিজস্ব অনুসন্ধান ও চিন্তাভাবনা, কর্মরত প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতার সঙ্গে জড়িত নয়।)
    (তথ্যসূত্র: https://www.pewtrusts.org/en/research-and-analysis/issue-briefs/2022/11/more-than-100000-fishing-related-deaths-occur-each-year-study-finds)।
    (সোর্স: https://coastbd.net/dignified-compensation-for-the-fishing-ban/)