সংবিধানের ‘গোড়ার গলদ’ এককেন্দ্রিকতা

এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা একধরনের একক, অখণ্ড ও সুসংবদ্ধ সরকারব্যবস্থা, যেখানে সাংবিধানিকভাবেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা একচ্ছত্রভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রই থাকে সব ক্ষমতার উৎস। বর্তমান সংবিধানের এককেন্দ্রিকতা এবং তা থেকে উদ্ভূত সংকট নিয়ে লিখেছেন মিল্লাত হোসেন

সংবিধান

গণপরিষদের ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, তাতে একটি ‘গলদ’ ছিল, তা-ও আবার একেবারেই গোড়ায়। এই প্রমাদ ঘটেছিল সংবিধানের একেবারেই প্রথম অনুচ্ছেদের একটিমাত্র শব্দ দিয়ে; সেই শব্দ হলো বাংলায় ‘একক’ আর ইংরেজিতে ‘ইউনিটারি’।

প্রথম অনুচ্ছেদটি হুবহু পড়া যাক (বাংলা ও ইংরেজিতে), ‘বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” নামে পরিচিত হইবে। (বাংলাদেশ ইজ আ ইউনিটারি, ইনডিপেনডেন্ট, সভরেন রিপাবলিক টু বি নোউন অ্যাজ দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ)

‘ইউনিটারি’ শব্দের অনুবাদ অবশ্য ‘একক’ করাটা যে ভুল ছিল, সেটি খসড়া সংবিধানের বাংলা তরজমাকারী ড. আনিসুজ্জামান পরে স্বীকার করেছেন। শব্দটি আসলে হওয়ার কথা এককেন্দ্রিক। এই শব্দের সাংবিধানিক পরিভাষা হলো, এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা; আর এর বিপরীতটা হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা (ফেডারেল)।

শব্দের অনুবাদে ভুল-শুদ্ধ যা-ই হোক, তার ব্যাকরণগত ফলাফল খুব বেশি হয়নি; কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামো নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ধারণাগত বিপত্তি, তার ফল সুদূরপ্রসারী হয়েছে। এতে যা হয়েছে, তা হলো বর্তমানে বাংলাদেশ নামে চিহ্নিত ভূখণ্ডের মানুষদের শাসনব্যবস্থা বা রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিরল’ একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য জেনেবুঝেই এটি করা হয়েছে, তেমনটি মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে যেসব সাক্ষ্য–প্রমাণ মেলে, তাতে সে সময় এই বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারা যায়নি বলেই প্রতীয়মান হয়।

গণপরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘মিস্টার স্পিকার স্যার, ইউনিটারি ফর্ম অব গভর্নমেন্ট আমরা গ্রহণ করেছি। এখানে ফেডারেল ফর্ম অব গভর্নমেন্ট আমরা গ্রহণ করেনি।’ গণপরিষদের পুরো কার্যবিবরণী খুঁজে এ বিষয়ে আর কারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রকাঠামোয় এমন গুরুতর রূপান্তর যে ঘটানো হয়েছে, সে রকম একটি বিষয় সম্পর্কে যে আসলেই অনেক ভাবনাচিন্তার দরকার ছিল, এর দার্শনিক বা রাজনৈতিক ভিত্তি বা যুক্তি সে সম্পর্কে কোনো উল্লেখই পাওয়া যায় না। আবার জনগণের পক্ষ থেকে এমন কোনো দাবিদাওয়া ছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায় না।

এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা একধরনের একক, অখণ্ড ও সুসংবদ্ধ সরকারব্যবস্থা। যেখানে সাংবিধানিকভাবেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা একচ্ছত্রভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রই থাকে সব ক্ষমতার উৎস। এতে আঞ্চলিক বা স্থানীয় সরকারের অস্তিত্ব থাকতে পারে; এই সরকারগুলো কিছু কিছু ক্ষমতা উপভোগও করতে পারে; তবে তাদের যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া; আর তার ‘নাটাই’ সব সময়ই কেন্দ্রের হাতে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া এখতিয়ার হিসেবেই এই স্থানীয় সরকারগুলো তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে। কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছা করলে এই ক্ষমতা কমাতে-বাড়াতে পারে, বাতিলও করে দিতে পারে। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় বা আঞ্চলিক সরকারগুলোর কোনো সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকে না।

বাহাত্তরের সংবিধানের মূল কাঠামোটা ‘ভালো’ বা ‘মন্দের ভালো’—এটা তথাকথিত নিন্দুকেরাও কেন স্বীকার করেন? এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশে নানা বিপরীত ধরনের ও মতাদর্শের শাসকেরা ক্ষমতায় এসেছেন, গেছেন; বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা, সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এক-এগারোর জরুরি অবস্থার সরকার এবং সদ্য উৎখাত হওয়া ভোটারবিহীন সরকার এই সংবিধান দিয়েই সরকার চালিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের সরকারগুলোর সবাই কমবেশি সংবিধানে কাটাছেঁড়া করেছে, যার যখন যত দূর প্রয়োজন ছিল; কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেউই সংবিধানটি পুরোপুরি বাতিল করে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করেনি। অর্থাৎ শাসক যে-ই হোক এবং তাদের মত-পথ যা-ই হোক, এই সংবিধান দিয়ে সবার উদ্দেশ্যই পূরণ হয়েছে।

আমাদের সংবিধানের ধরন ও এটি টিকে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে, তবে বিশেষ একটি কারণ এটিকে দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করেছে। সেটি হলো, আমাদের সংবিধানটা এমনভাবে প্রণীত হয়েছে, যেন সেটি সব সময়ই এক ব্যক্তির বা একটি দলের শাসনের উপযোগী থাকে। আর এই উপযোগিতার বড় অংশটাই আসে এর এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে। ভোটের এক দিন বা ‘এক রাতের পারফরম্যান্সে’ পুরো দেশের সব ক্ষমতা দখল করার মতো মজার রাষ্ট্রকাঠামো আর কীভাবেই-বা মিলবে?

এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয়—এই দুই শাসনব্যবস্থার ফারাক ব্যবহারিকভাবে বুঝতে চাইলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে চোখ রেখে মোকাবিলার উদাহরণটাই যথেষ্ট। ফেডারেল সরকার ও দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা হওয়ার কারণে দেশটিতে কিছুদিন পরপরই নির্বাচনের দামামা বাজে। একটি নির্বাচনে জিতেই কেউ আয়েশ করে বসে থাকতে পারে না। এ জন্য সব দলকেই ক্রমাগত দৌড়ের ওপরেই থাকতেই হয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রেরও উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মূল বিষয় হলো, একটি দেশে যদি অন্তত দুই ধরনের সরকার (কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক) থাকে, তাহলে কোনো দল কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হওয়ার হুমকিতে পড়লে সেই দলটির সুযোগ থাকে স্থানীয়ভাবে দলকে রক্ষা করার।

আমাদের সংবিধানটি ১৯৭২-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হলেও শাসনব্যবস্থাটা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকেই চলে আসছে। ১৯৭২ সালে কেবল সেখানে সরকারি সিলমোহর পড়ে। অবশ্য আইনগতভাবে শাসনব্যবস্থাটা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকেই শুরু বলে ধরে নেওয়া হয়। কারণ, সেদিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।

তাহলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বা ২৬ মার্চ থেকে পেছনে গেলে কী দেখা যায়? প্রথমে পাবেন পাকিস্তান; সেটি তখন পূর্ব পাকিস্তান; পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নামের মোট পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র ছিল। তার আগে ছিল ব্রিটিশ আমল। তখন ব্রিটিশ ছত্রচ্ছায়ার নিচে ছিল বাংলা, সেন্ট্রাল প্রভিন্স, মাদ্রাজ, বোম্বে, যুক্ত প্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব ইত্যাদি প্রদেশ। তার আগে ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত মোগল আমল। এই আমল ও এর আগের বিশুদ্ধ মোগল আমলে সুবা নামে এলাকাগুলো ভাগ করা ছিল। সম্রাট রাজধানী দিল্লিতে থাকলেও সুবাগুলো অনেকটাই নিজের মতো করে শাসন করতেন সুবাদাররা। এর মধ্যে অনেক দেশীয় রাজ্যও থাকত প্রায় স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদায়।

বাস্তব কারণেই ব্রিটিশ আমলের আগে দিল্লি বা বহুদূরের রাজধানী থেকে প্রত্যক্ষভাবে দেশ শাসন করার সুযোগই ছিল না। যোগাযোগব্যবস্থা আর ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে সুবা বা প্রদেশে ভাগ ভাগ করে সাম্রাজ্য শাসন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। ইতিহাসব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মতো একটু উদার ও ঢিলেঢালা শাসনে থাকা মানুষদের হঠাৎ তাদের সম্মতি না নিয়ে একটি শব্দের মারপ্যাঁচে তাদের রাষ্ট্রের ও শাসনব্যবস্থার চরিত্র বদল করা হলো। শাসনব্যবস্থা বদলে দিলেও নাগরিকদের মনের রাজনৈতিক গড়ন কি বদলে গেছে?

১৯৭০ সালের যে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আমাদের সংবিধান তৈরি করার জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল, সেই নির্বাচনটা হয়েছিল লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার, ১৯৭০ (এলএফও)-এর আওতায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রটিই তখন পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র ছিল।

আবার এলএফওতেও সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রটা আরও প্রসারিত করে পশ্চিম পাকিস্তানকে এক ইউনিট বিবেচনা করা বাদ দিয়ে আগের মতো পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নামের চারটি প্রদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেই নতুন সংবিধান তৈরির ম্যান্ডেট দেওয়া হয়। এই এলএফওর শর্ত অনুযায়ী অবিভক্ত পাকিস্তানের জন্য একটি নতুন সংবিধান তৈরি করতে এই নির্বাচনটা করা হয়েছিল। সেই বিবেচনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে গণ-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়নি। 

যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি নেওয়ার প্রশ্নে এর বিরুদ্ধবাদীরা যেসব যুক্তি দিতে চান, তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো, আমাদের রাষ্ট্রের আয়তন ছোট, আমাদের মধ্যে বড় মাপের জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাভিত্তিক বিভাজন না থাকা ইত্যাদি। তাঁদের মতে, এগুলোর উপস্থিতি থাকলেই যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

এটা সত্যি, বাংলাদেশের আয়তন মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এ দেশের ১৭ কোটি জনগণের ৯৯ শতাংশই জাতি ও ভাষাগতভাবে বাঙালি ও বাংলাভাষী, জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিম। কিন্তু এককেন্দ্রিকতার সমর্থকেরা যেসব যুক্তি তুলে ধরতে চান, সেগুলো কতটা যৌক্তিক? যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য থাকে জনগণের সার্বভৌমত্ব ও গঠনগত ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত না রেখে যত পারা যায় তত বিকেন্দ্রীকরণ করা; এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির সর্বাধিক প্রতিফলন ঘটিয়ে জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা ও সুরক্ষা দেওয়া, জনগণের কাছে সরকারকে নিয়ে যাওয়া এবং স্বৈরাচারী ক্ষমতার উত্থানকে যথাসম্ভব ঠেকিয়ে রাখা।

 ওয়ার্ল্ডোমিটারের ২০২৪ সালের হিসাবে ২৩৪টি দেশের মধ্যে মাত্র ৩৫টির জনসংখ্যা ঢাকার চেয়ে বেশি! বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ কানাডার চেয়ে আমাদের উত্তরাঞ্চলের জনসংখ্যা বেশি। নেপাল ও আইভরিকোস্টের চেয়ে বেশি জনসংখ্যা আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের। আর জনসংখ্যার বিচারে আমাদের সবচেয়ে ছোট অঞ্চল সিলেট-ময়মনসিংহ যদি একটি স্বাধীন দেশ হতো, তাহলে লোকসংখ্যায় এটি হতো পৃথিবীর ৬০তম দেশ! এই উচ্চ সংখ্যার একটি দেশ এককেন্দ্রিক শাসনে পরিচালিত হওয়া যে সুশাসনের ঘোর অন্তরায়, সেটি তো আগে আমাদের ওপর জেঁকে বসা অপশাসনগুলো থেকেই বোঝা যায়।

আমাদের সংবিধানের আরও একটি গভীরভাবে ভাবতে না পারা বিষয় হলো, নতুন সৃষ্ট দেশের সব নাগরিককেই বাঙালি বলে ঘোষণা দেওয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাগরিকেরা বাঙালি হবেন, খসড়াতে কিন্তু এটা ছিল না; ছিল নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া নামের একজন সদস্য সংশোধনী আনেন যে দেশের সব নাগরিক বাঙালি বলে পরিচিত হবেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার তীব্র প্রতিবাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই এই সংশোধনী পাস হয়ে যায়।

 ভাষার দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখব যে পুরো দেশের প্রধানতম ভাষা বাংলা। ৫৩ বছর ধরে আমরা এককেন্দ্রিকতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকার পরও চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ ইত্যাদি অঞ্চলের ভাষা স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেই বহাল তবিয়তে আছে। অথচ এসব অঞ্চলের লোকেরা একে অপরের ভাষা বুঝতে পারে না এখনো। মনে রাখা যেতে পারে, ভাষাতাত্ত্বিকেরা চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুরের ভাষাকে বাংলা ভাষাই গণ্য করেন না। কারণ, একই ভৌগোলিক বাতাবরণে বসবাস করার পরও যে ভাষাভাষীরা একে অপরের ভাষা বুঝতে পারেন না, সেসব ভাষাকে ভাষাতত্ত্বে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ইতিহাস, ভূ–প্রকৃতি, জনমিতি ও ভাষার পর আমরা সর্বশেষ নির্বাচনী পরিসংখ্যান দিয়ে আমাদের এককেন্দ্রিকতাকে বিচার করে দেখতে পারি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের মতো বিজয়ীদের ভূমিধস বিজয়ের নির্বাচনের দিকে তাকালেও আঞ্চলিক জনপ্রিয়তা ও জনভিত্তির কিছু আগ্রহোদ্দীপক চিত্র পাওয়া যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে মাত্র ৬২ আসন পেয়ে হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগ কিন্তু খুলনা ও ঢাকা অঞ্চলে ভোট সবচেয়ে বেশি পেয়েছিল। অর্থাৎ প্রাদেশিক সরকার থাকলে জাতীয় নির্বাচনে ভোটে খারাপভাবে হারা দলও খুলনা আর ঢাকা প্রদেশে সরকার গঠন করতে পারত। অন্যদিকে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মাত্র ৩১টি আসন পেয়ে প্রায় ধুয়েমুছে যাওয়ার উপক্রম হলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৮টি আসন পায় এবং সে অঞ্চলে বিএনপি নিজেদের প্রবল জনভিত্তির প্রমাণ রাখে।

এসব ভোটভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত থেকে আমাদের দেশে ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা নয়; বরং বহুকেন্দ্রিকতারই জোরালো ভিত্তি আছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অথচ এককেন্দ্রিকতার এক আদি ভুলের মাশুলই হয়তো আমাদের ৫৩ বছর ধরে দিয়ে আসতে হচ্ছে।

আমাদের সংবিধানের আরও একটি গভীরভাবে ভাবতে না পারা বিষয় হলো, নতুন সৃষ্ট দেশের সব নাগরিককেই বাঙালি বলে ঘোষণা দেওয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাগরিকেরা বাঙালি হবেন, খসড়াতে কিন্তু এটা ছিল না; ছিল নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া নামের একজন সদস্য সংশোধনী আনেন যে দেশের সব নাগরিক বাঙালি বলে পরিচিত হবেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার তীব্র প্রতিবাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই এই সংশোধনী পাস হয়ে যায়।

এই ভুল সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামানও শেষকালে অনুতাপ প্রকাশ করে বলেই ফেলেছেন, ‘পাহাড়িদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য যে সেদিন আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হইনি, এ ছিল নিজেদের বড় রকম এক ব্যর্থতা। ... ৬ অনুচ্ছেদের ওই ছোট্ট সংশোধনীকে উপলক্ষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতিত্বের সঙ্গে পাহাড়িদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যে বিরোধ সেদিন সূচিত হলো, তার ফল কত সুদূরপ্রসারী হয়েছিল তা এখন আমরা জানি।’ (বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা প্রকাশন)

পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের বাংলাদেশি বলে ঘোষণা করে এই ভুল শুধরে নেওয়া হলেও পরে আদালতের রায়ের মাধ্যমে সেই সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়। এরপর পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়ে নতুন করে গোঁজামিল দিয়ে হলেও সংবিধানের এই আদি ভুলের কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম অনুচ্ছেদের আদি ভুলটার স্বীকৃতিও এখনো কেউ দেননি। আদৌ কেউ দেবেন কি না, তা-ও ঘোর অনিশ্চিত।

  • মিল্লাত হোসেন সংবিধান ও আইন বিষয়ে লেখক ও গবেষক