উত্তর-পূর্ব ইউরোপের ছোট্ট যে দেশে আমি থাকি; বলা হয়ে থাকে, এটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ই-কান্ট্রি। অর্থাৎ, এই দেশটিই প্রথম নিজেদের জাতীয় নির্বাচনে অনলাইনে ভোট দিয়েছে। শুধু ভোট দেওয়া নয়। আমরা সবকিছু অনলাইনে করতে পারি। কিছু উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।
আমি একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছি বছর কয়েক আগে। এর জন্য আমাকে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে। কিন্তু আমাকে একবারের জন্যও ব্যাংকে যেতে হয়নি। আমি অনলাইনে আবেদন করেছি। তারা আমার সব তথ্য অনলাইনের মাধ্যমেই জানতে পেরেছে। আমার আইডি নম্বর দিয়েই তারা জানতে পারছে, আমি কী করি, কত টাকা বেতন পাই ইত্যাদি। এর ভিত্তিতে তারা আমাকে ঋণ দিয়েছে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ব্যাংকে যেতে হয়নি। কারও সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথাও বলতে হয়নি।
অ্যাপার্টমেন্টও আমি কিনেছি কোথাও না গিয়েই। ঘরে বসেই পুরো রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা গেছে। আমরা এখানে স্বাক্ষরটা পর্যন্ত অনলাইনে করি। সবারই স্মার্ট আইডি আছে। অর্থাৎ, ন্যাশনাল আইডি নম্বর দিয়ে দিলে একটা সফটওয়্যারের মাধ্যমেই আমরা যেকোনো কিছু ডিজিটাল স্বাক্ষর করে ফেলতে পারি। আমাদের সবার মুঠোফোনেই সেই অ্যাপস আছে। সেখানে প্রথমে একটা কোড আসে।
এরপর নিজেদের পিন নম্বর দিতে হয়। এরপর যেকোনো ডকুমেন্ট অটোম্যাটিক্যালি সাইন হয়ে যায়।
এত কথা বলার কারণ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছি বাংলাদেশ নাকি ‘স্মার্ট’ হতে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের পরবর্তী নির্বাচনের স্লোগান এটি। স্মার্ট দেশে বসে যখন শুনতে পাই বাংলাদেশ ‘স্মার্ট’ হতে চলেছে, তখন ভালোই লাগে। মনে হয়, বেশ তো। মন্দ কী। কিন্তু এই গ্রীষ্মে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে মনে হচ্ছে, আমাদের কি আদৌ স্মার্ট হওয়া দরকার, নাকি আগে সভ্য হওয়া দরকার
দেশে এসে যেসব অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এর কিছু উদাহরণ বরং দেওয়া যাক। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি। ছয়তলায় উঠতে হবে। লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আমি লিফটের বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে। যাতে করে যাঁরা লিফট থেকে বের হবেন, তাঁরা যেন আগে বের হতে পারেন। এরপর আমি উঠব। লিফট নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে দেখি আশপাশ থেকে ছেলে-মেয়ে এসে যে যার মতো ঠেলাঠেলি করে লিফটে উঠে গেল! আমি উঠতেই পারলাম না! অথচ সিরিয়ালে আমিই সবার আগে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রিকশায় উঠলে হয়তো রাস্তায় হেঁটে-বেড়ানো মানুষদের আমরা আর সেই অর্থে চোখেই দেখি না। কিংবা রিকশায় উঠলে নিজেদের বড় মনে হয়! হেঁটে যাচ্ছি। পাশ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে। এক ভদ্রমহিলা মনের আনন্দে তাঁর সর্দি ঝেড়ে দিলেন! পাশ দিয়ে যে কোনো মানুষ হেঁটে যেতে পারেন, এটি আর তাঁর মনে করার কোনো দরকার নেই।
সভ্য দেশগুলোতে আমরা যেকোনো লিফটে উঠতে গেলে বাঁয়ে কিংবা ডানে দাঁড়িয়ে থাকি। সবাই নেমে গেলে এরপর সিরিয়াল অনুযায়ী যারা আগে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা উঠি এক এক করে। অথচ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা জায়গায় যে যার মতো করে উঠে যাচ্ছে। লিফটে থাকা মানুষজনকে বেরও হতে দিতে চাইছে না!
শেষমেশ লিফটে উঠেও রক্ষে নেই! বের হতে চাইছি। সবাই এমনভাবে গাদাগাদি করে আছে, কেউ জায়গা পর্যন্ত দিচ্ছে না বের হওয়ার। একজন আরেক জনের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। লিফটের এই অবস্থা দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর লিফটে উঠব না। তার চেয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করাই ভালো। তো সিঁড়ি দিয়ে পরের দিন উঠছি। হঠাৎ দেখি, কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ওপরে উঠে চলে গেল! সে যে আমাকে ধাক্কা দিয়েছে, তার যে ‘দুঃখিত’ বলা উচিত, এমন কোনো কিছুই দেখলাম না। কোনো বিকার নেই। সোজা ওপরে উঠে গিয়েছে মনের আনন্দে!
রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, দেখি এক ভদ্রলোক মনের আনন্দে আম খাচ্ছেন। আমি তাঁর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আমের আঁটিটা হঠাৎ উল্টো দিকের দেয়ালে ছুড়ে মেরেছেন। আর মিলি সেকেন্ড দেরি হলে আমার গায়ে এসেই পড়ত। অথচ ভদ্রলোকের দেখছি কোনো বিকার নেই। আমার তো ধারণা, তিনি পরবর্তী আম খাওয়ার সময়ও এই কাজই করবেন।
রিকশায় উঠলে হয়তো রাস্তায় হেঁটে-বেড়ানো মানুষদের আমরা আর সেই অর্থে চোখেই দেখি না। কিংবা রিকশায় উঠলে নিজেদের বড় মনে হয়! হেঁটে যাচ্ছি। পাশ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে। এক ভদ্রমহিলা মনের আনন্দে তাঁর সর্দি ঝেড়ে দিলেন! পাশ দিয়ে যে কোনো মানুষ হেঁটে যেতে পারেন, এটি আর তাঁর মনে করার কোনো দরকার নেই।
এমন হাজারটা উদাহরণ আসলে দেওয়া সম্ভব। সভ্য সমাজে এসব করা যে সম্পূর্ণ বেমানান; আমাদের কেউ শেখায় না। তাই বড় বড় ডিগ্রি নিয়েও এই সমাজের মানুষজন দিব্যি মনের আনন্দে এসব করে বেড়াচ্ছেন। আগে তো সভ্য হতে হবে, এরপর না হয় স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করা যাবে।
ছোটবেলায় স্কুল-কলেজগুলোতে ১০-১২টা বই হাতে ধরিয়ে না দিয়ে; বরং এসব শেখানো উচিত। নইলে বিশ্বায়নের এই যুগে কেউ তো আমাদের সভ্য হিসেবেই স্বীকৃতি দেবে না। থাক তো স্মার্ট হওয়া! তা ছাড়া সভ্য না হয়ে স্মার্ট হওয়া কি আদৌ সম্ভব? কিংবা সেই স্মার্টনেস কি আমরা আদৌ ধরে রাখতে পারব?
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: [email protected]