কর্কট রোগে আক্রান্ত আনন্দ দাস আমার নিকটতম প্রতিবেশী। মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি তাঁর বসতবাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এরপর স্ত্রীর নামে মেয়াদি সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন ডাকঘর থেকে।
স্বামীবিয়োগের পর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে শান্তিবালা যেন নতুন ও কঠিন জীবনে প্রবেশ করলেন। গৃহবধূ থেকে রূপান্তরিত হন গৃহকর্মীতে। টানা কাজ করেন কয়েকটা বাসায়; কাজের মাইনে আর সঞ্চয়পত্রের মুনাফা, এ দুই দিয়ে কোনোভাবে সংসারের ব্যয় মেটান। সংসারের খরচের কি কোনো মাত্রা আছে? ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বাসাভাড়া, খাওয়াদাওয়া, অসুখ-বিসুখের খরচ, মেহমানদারি আরও কত কী! দিন দিন খরচ বাড়ছে, তবে কমে যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার। গরিবের পোড়া কপাল, তাতে দুঃখ ছাড়া আর যেন কিছু লেখা থাকে না।
জীবন কোনোভাবে কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে সেখানেও দেখা দিল ঘোর বিপত্তি। ডাকঘর থেকে জানানো হলো, মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের ব্যাপ্তিকাল শেষ হয়ে এসেছে। এখন থেকে ডাকঘরে আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কেনা বা নবায়ন করা যাবে না। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, আগে টাকা জমা রাখতে হবে ব্যাংকে; এরপর এমআইসি চেকের (এটা কোন ধরনের চেক, জানতে খুব কৌতূহল হলো শান্তিবালার) মাধ্যমে ডাকঘরের সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। কর্তৃপক্ষ সদয় হয়ে আরও অবহিত করলেন, ইতিমধ্যে বেশ কটি ব্যাংক সঞ্চয়পত্র কেনাবেচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এমআইসি চেকের জটিলতা এড়িয়ে ওখান থেকে যদি...ইত্যাদি ইত্যাদি!
উদ্বিগ্ন শান্তিবালা জনৈক বুঝদার ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে গেলেন। সেখানে গিয়ে জানলেন, সঞ্চয়পত্র কেনার জন্যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তো লাগবেই, সঙ্গে লাগবে টিআইএন নম্বরও। বস্তুত, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট শব্দটির সঙ্গে শান্তিবালার কিঞ্চিৎ পরিচয় আছে, কিন্তু টিআইএন নম্বর জিনিসটা কী, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শান্তিবালা ওই ব্যক্তির পরামর্শমতো কিঞ্চিৎ বিনিয়োগ করলেন এবং টিআইএন নম্বর খুলে সঞ্চয়পত্র কিনে বাড়িতে ফিরলেন।
স্বল্প আয়ের মানুষ কিংবা জমি বিক্রি করা কোনো প্রান্তিক কৃষক যিনি কারবার বা সুদে টাকা খাটানোর প্রক্রিয়া জানেন না, তিনি যদি চারপাশের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দেয়াল এড়িয়ে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা রাখেন, তাহলে সরকারের কি উচিত নয় তাঁর বিশ্বাস ও নির্ভরতাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া? কিন্তু এর বদলে সরকারের কাছে থাকা টাকার হিসাব–নিকাশ সরকারই চাচ্ছে, টাকার মালিকের কাছে, কিন্তু কেন? মূলধনসহ এ হিসাব তো তার কাছেই আছে।
বছর দুই পর শান্তিবালার কানে এল ভয় জাগানিয়া খবর। তাঁর আয়ের ওপর সরকারের নাকি চোখ পড়েছে। সরকার তাঁর আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে চায়। ‘আয়কর রিটার্ন’ জমা দিয়ে ওই হিসাব দাখিল হবে। রিটার্ন না দিলে...ইত্যাদি ইত্যাদি। ভীত, সন্ত্রস্ত শান্তিবালা আবারও সেই বুঝদার ব্যক্তির শরণাপন্ন হন। তাঁর পরামর্শ ও নির্দেশনা মোতাবেক বার্ষিক আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন।
শান্তিবালা জানতেন না যে ওই রিটার্ন প্রতিবছরই দাখিল করতে হবে। তাঁর লেখাপড়া নেই, তিনি কত কিছুই জানেন না। কত রকমের ভুল করে থাকেন। কিন্তু সরকার বাহাদুর তো কোনো রকম ভুল করলে চলে না; বিশেষত শান্তিবালাদের ক্ষেত্রে। সবলকে এড়ানো, দুর্বলকে পেটানোই বাঙালির বৈশিষ্ট্য। সরকার ওই বৈশিষ্ট্যের বাইরে থাকবে কেন?
পরের বছর আয়কর অফিস থেকে এল কড়া নোটিশ। যথাসময়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করে শান্তিবালা নাকি অসচেতন ও অনাগরিকসুলভ আচরণ করেছেন এবং সদাশয় সরকারকে তার প্রাপ্য কর থেকে বঞ্চিত করে চলেছেন। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে সশরীর হাজির হয়ে তাঁকে ‘কারণ’ ব্যাখ্যা করতে হবে, অন্যথায়...ইত্যাদি ইত্যাদি। বস্তুত, সরকারই যেহেতু শান্তিবালার রক্ষক ও অভিভাবক, তাই এ অভিযোগকে ‘ভয়ংকর বিপদ’ মনে হলো তাঁর। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি কী করবেন বা কী করতে পারেন? তাঁর বিত্ত এবং বিদ্যার ভাঁড়ার দুটোই যে শূন্যের প্রকোষ্ঠে বন্দী।
২.
এরপরের গল্পটা বেশ করুণ ও পীড়াদায়ক। শান্তিবালা এবার এলেন আমার কাছে। আমি তাঁর অনুরোধ এড়াতে না পেরে আয়কর অফিসে গেলাম।
অফিসের বড় কর্তাকে বললাম, এই ভদ্রমহিলা লেখাপড়া জানেন না। নাম দস্তখত করার কাজটা কোনোভাবে রপ্ত করেছেন মাত্র। তাঁর পক্ষে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ করা সাধ্যাতীত ব্যাপার।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন বড় কর্তা, সঞ্চয়পত্রের বদৌলতে তিনি কি সরকারের কাছ থেকে মুনাফা নেন?
আমি মিনমিনে কণ্ঠে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ, মুনাফা নেন বটে।
মুনাফা নিলে, অবশ্যই সে মুনাফার বিবরণ দিয়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
কিন্তু তিনি তো লেখাপড়া জানেন না। রিটার্ন ফরম লিখবেন কী করে?
লিখতে না পারলে অন্য একটা কাজ করতে বলুন। সঞ্চয়পত্র না কিনে নগদ টাকাগুলো বিছানায় রেখে ওম দিতে বলুন।
বড় কর্তার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত ও বাক্হীন হয়ে গেলাম। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম। তিনি আমার সঙ্গে বাক্য ব্যয় না করে শান্তিবালাকে কাছে ডাকলেন; ভরাট কণ্ঠে বললেন, আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে সরকার যেকোনো সময় মুনাফার সমুদয় টাকা কেড়ে নিতে পারে। এমনকি, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকৃত পুরো মূলধনও বাজেয়াপ্ত করতে পারে।
বড় কর্তার হুঁশিয়ারি শোনার পর ভয়ার্ত শান্তিবালা আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখমুখ যেন বলতে চাইছে, ‘সমস্যার সমাধান করার জন্য আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি তো সবকিছু তামাদি করে দিচ্ছিলেন প্রায়।’
৩.
অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে শান্তিবালাদের ‘জন্মই যেন আজন্মের পাপ’। বাড়ি-জমি বেচে কয়েক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনলে টিআইএন নম্বর লাগে তাঁদের; ফি বছর আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া লাগে। যাঁরা টিআইএন কিংবা আয়কর রিটার্ন নামক প্রপঞ্চের মর্মার্থ তো দূরের কথা, নিজের নামটাও লিখতে জানেন না, রাষ্ট্র তাঁদের কত কী পরীক্ষা দিতে বাধ্য করছে! তাঁদের জন্য কত আইন, কত রকম বিধি; এসব আইন ও বিধিÑসব সময় কি সরলপথে, সমানগতিতে চলে?
একজন নিরক্ষর মানুষ যিনি গতর খাটিয়ে বা সম্পত্তি বিক্রি করে অর্জিত অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে চান, তাঁর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টিআইএন নম্বর খোলা কিংবা ফি বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হলো কেন? এটা কি বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো কঠোর অপচেষ্টা নয়? স্বল্প আয়ের মানুষ কিংবা জমি বিক্রি করা কোনো প্রান্তিক কৃষক যিনি কারবার বা সুদে টাকা খাটানোর প্রক্রিয়া জানেন না, তিনি যদি চারপাশের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দেয়াল এড়িয়ে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা রাখেন, তাহলে সরকারের কি উচিত নয় তাঁর বিশ্বাস ও নির্ভরতাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া? কিন্তু এর বদলে সরকারের কাছে থাকা টাকার হিসাব–নিকাশ সরকারই চাচ্ছে, টাকার মালিকের কাছে, কিন্তু কেন? মূলধনসহ এ হিসাব তো তার কাছেই আছে। তাহলে? সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলা—এটা তো সরকারের কাজ হতে পারে না।
অক্ষরজ্ঞানহীন ছাপোষা মানুষকে দিয়ে টিআইএন নম্বর খুলিয়ে ফি বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে বাধ্য করা, এটা বোধ হয় বাঙালকে ‘হাইকোর্ট’ নয়, ‘সুপ্রিম কোর্ট’ দেখানোর চেয়ে ভোগান্তি ও দুর্ভোগের পদক্ষেপ।
বিধান মিত্র অধ্যাপক, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ, নেত্রকোনা