প্রায় এক বছর ধরে ন্যাটোর কাছে অনুনয়-বিনয়ের পর পশ্চিমা নিরাপত্তা জোটটি তাদের মিত্রদেশ ইউক্রেনকে অগ্রসর প্রযুক্তির মেইন ব্যাটল ট্যাংকস (এমবিটিএস) দিতে সম্মত হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে এ পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। কিন্তু এমন এক সময়ে এ সিদ্ধান্ত এসেছে, যখন কিয়েভ দখলে নেওয়ার প্রচেষ্টা অসফল হওয়ায় রুশ বাহিনী পূর্ব ইউক্রেনে নিজেদের অধিকৃত ভূখণ্ড ও ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পশ্চাদপসরণ করেছে।কিয়েভ যুদ্ধে বিজয় এবং সেখান থেকে রুশ বাহিনীর পশ্চাৎপদসরণের ঘটনাকে ইউক্রেন মস্কোর সঙ্গে মীমাংসার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু সেটা না করে বরং উল্টো আক্রমণাত্মক অবস্থানে চলে গেছে।
প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ আক্রমণাত্মক যুদ্ধে মোড় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেনীয়দের দিক থেকে যুদ্ধের হাওয়া বদলে যেতে শুরু করেছে। রিজার্ভ ফোর্স থেকে সাড়ে তিন লাখ সেনা নিয়োগ দিয়ে ইউক্রেনের নড়বড়ে সেনাবাহিনীর ওপর ব্যাপক পাল্টা আঘাতের সক্ষমতা গড়ে তুলেছে রাশিয়া। পুরোপুরি বিপর্যয় যাতে না হয়, সে জন্য ন্যাটো জোট একেবারে শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে এমবিটিএস ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা তাঁদের যুক্তিবোধ ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এ সিদ্ধান্তে অনেকটাই চিয়ারলিডার্স বা মনোরঞ্জনকারীর ভূমিকায় (উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অন্যান্য কর্মকাণ্ডও আছে) হাজির হয়েছেন।
কিন্তু কেউ যদি খুব ভালো করে এ যুদ্ধের সময়কালটা লক্ষ করেন, তাহলে তিনি কী দেখতে পাবেন? ইউক্রেনকে দেওয়া ন্যাটোর অপ্রতুল ও অপরিকল্পিত সামরিক সহায়তা এবং এখন পর্যন্ত রাশিয়ান বাহিনীর সীমিত চাপে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে, তাতে বলাই যায়, ন্যাটোর সিদ্ধান্ত ভুল, বিপজ্জনক, এমনকি নিরর্থক। ন্যাটোর এসব পদক্ষেপ ইউক্রেনের জন্য সহায়ক তো হচ্ছেই না, বরং এতে আরও বেশি ইউক্রেনীয়র মৃত্যু হবে এবং পশ্চিমের সঙ্গে আরও বড় পরিসরে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
ইউক্রেনে ন্যাটো কী পাঠাচ্ছে
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্য ইউক্রেনে ১৪-১৫ চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক পাঠাচ্ছে। অনেকবার পিছলানোর পর জার্মানি তাদের লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠাতে সম্মত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের এম-১ আব্রাহামস ট্যাংক পাঠাতে রাজি হয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্ব যখন ঊর্ধ্বশ্বাসে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেনের জয় ঘোষণা করে চলেছিল, ইউক্রেন সে সময় তাদের কাছে ৩০০টি এমবিটিএস ট্যাংক ভিক্ষা চেয়ে যাচ্ছিল। আর এ ফাঁকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী এলাকায় রাশিয়া শুধু সাড়ে তিন লাখ সেনা মোতায়েনই করেনি ২০০টি টি-৯০ এমবিটিএস ট্যাংকও নিয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছে
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এম-১ আব্রাহামস ট্যাংক দিতে দ্বিধা করছে। এর কারণ হলো এটি তাদের কাছে থাকা অগ্রসর প্রযুক্তির ট্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর। এ ধরনের ট্যাংক উৎপাদনের সক্ষমতা এখন আর আগের মতো নেই দেশটির। সে কারণে ইউক্রেনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্যাংক পাঠাতে পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বিব্রত বোধ করছেন।ইউক্রেনে যুদ্ধসহায়তা দিয়ে অস্ত্রভান্ডার ও যুদ্ধ সরঞ্জাম যেভাবে ফাঁকা হচ্ছে, তা পূরণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। নিজেদের ভান্ডার থেকে এম-১ আব্রাহামস ট্যাংক ইউক্রেনের হাতে না দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বস্তুগত সীমাবদ্ধতা আছে। এ কারণে নতুন ট্যাংক তৈরি করেই সেগুলো ইউক্রেনকে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন থেকে ৮-১২ মাস কিংবা আরও বেশি সময় পর ট্যাংকগুলো পেতে পারে ইউক্রেন। কিন্তু এত দেরিতে সেগুলো হাতে পাওয়ার প্রত্যাশা করে না ইউক্রেন।
উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কাছে আইকনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এম-১ আব্রাহামস ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি সংখ্যায় খোয়া যাক, সে ঝুঁকি নিতে চায় না ওয়াশিংটন। সেটা তাদের জন্য অপমানজনক হবে। ইউক্রেনকে এখন এফ-১৬এস-এর মতো অগ্রসর প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান দেওয়ার আহ্বান আসছে। কেননা, এ ধরনের যুদ্ধবিমান ছাড়া ন্যাটোর দেওয়া ট্যাংক রাশিয়ার যুদ্ধবিমানগুলোর সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে যাবে।ইউক্রেনে অত্যাধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা আরেকটি যৌক্তিক কারণে দোদুল্যমান। এ ধরনের যেকোনো পদক্ষেপকে রাশিয়া প্ররোচনার অজুহাত হিসেবে নেবে। এ ধরনের ক্রিটিক্যাল ব্যবস্থা পাঠানোর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অনীহার ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ‘ট্যাংক পাঠাচ্ছি’ বলা আর প্রকৃতপক্ষে ট্যাংক পাঠানো—এই দুয়ের মধ্যে ব্যবধানটা বিস্তর।
জার্মানির দিকটা বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে, তারা লেপার্ড-২ ট্যাংক পাঠাতে চাইলেও কবে সেটা পাঠাবে, সে রকম কোনো সময়সূচি নির্ধারণ করেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিশ্রুত ৩১টি ট্যাংক দেওয়ার ক্ষেত্রে সময়সূচি ঠিক করেছে। পোল্যান্ড তাদের লেপার্ড-২ এস এবং সোভিয়েত জামানার ট্যাংক দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
যা হোক, প্রতিশ্রুত সব কটি ট্যাংক যদি ন্যাটো ইউক্রেনে পাঠায়, তারপরও ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ঘিরে রাখা রাশিয়ান বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের তুলনায় তা সামান্য। এ ছাড়া অত্যাধুনিক ট্যাংকগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই ইউক্রেনীয়দের। বিশালাকার রাশিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের ট্যাংক দিয়ে যুদ্ধ করার কোনো অভিজ্ঞতাও তাঁদের নেই। আমেরিকানরা মূলত মৌলিক এ বিষয় নিয়ে চিন্তিত।
আমরা কিন্তু নিছক স্টিনজার কিংবা জ্যাভলিনের মতো পোর্টেবল ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে কথা বলছি না। আমরা কথা বলছি এমন এক ধরনের সমরাস্ত্রব্যবস্থা নিয়ে, যেটি পরিচালনার জন্য অনেক মাসের, অনেক বছরের প্রশিক্ষণ দরকার পড়ে। এমনটাও ঘটা অস্বাভাবিক নয়, যে সময়ে ইউক্রেনের সম্মুখসারির সেনারা ন্যাটোর প্রতিশ্রুত এমবিটিএস ট্যাংকের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে, সে সময়ে রাশিয়া তাদের টি-৯০ ট্যাংকের পুরো বহর যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়ে দিল।
আসুন, একটি অঙ্ক দিয়ে শেষ করি। ব্রিটেনের ১৪টি চ্যালেঞ্জার-২এস, পোল্যান্ডের ১৪টি লেপার্ড-২এস ও জার্মানির ১৪টি লেপার্ড-২ ট্যাংক মিলিয়ে মোট ৪২টি ট্যাংক। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ৩১টি এম-১ আব্রাহামস ট্যাংক যোগ করলে মোট এমবিটিএস ট্যাংকের সংখ্যা হয় ৭৩টি। কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের মধ্যে এ ট্যাংকগুলো ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে যুক্ত হবে।
ন্যাটো যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ ৩২১টি ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠাবে তারা। এগুলোর কতগুলো অগ্রসর প্রযুক্তির আর কতগুলো সোভিয়েত আমলের বাতিল ট্যাংক, তার হিসাব সময় হলেই বলা যাবে। পর্যাপ্ত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছাড়া অল্পসংখ্যক ট্যাংক নিয়ে শক্তিশালী রাশিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা আর ডন কুইক্সোটের যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবের মধ্যে বাস্তবে কি পার্থক্য আছে?
ব্র্যান্ডন জে উইচার্ট যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনীতি বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে