আগামী বাংলাদেশে জনগণ তার মালিকানাধীন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যে অর্থ জমা করবে, সেই অর্থ সদ্ব্যবহারের, অর্থাৎ জনগণের মধ্যে ইনসাফ অনুযায়ী বণ্টনের সবচেয়ে ভালো ও কার্যকর পন্থা কী হতে পারে?
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট’-এর ওপর এক পরামর্শ সভায় আলোচকেরা এই প্রশ্ন তুলেছেন।
ওই আলোচনা সভায় বলা হয়, ‘পাবলিক মানি’ বা সরকারি অর্থ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির মাত্র ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। এই অর্থ জনগণের মধ্যে বণ্টন ছাড়াও সরকার চাইলে কর কমানো-বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ কমানো–বাড়ানো, লাইসেন্স দেওয়া, লিজ দেওয়া, বিনিয়োগ ও সরবরাহের সুযোগ দেওয়া, মুদ্রানীতি—ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ধনী বানাতে পারে; আবার কোনো রকমে টিকে থাকা সুবিধাভোগীও বানাতে পারে।
সরকার যদি ঠিক করে, অমুক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আর্থিক সুবিধা দিতে হবে, তাহলে সরকার তার আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সুবিধা নিশ্চিত করে বিনিয়োগ ও সরবরাহব্যবস্থা ঠিক করতে পারে।
বিগত সময়ে আমরা বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকারের স্বজনতোষণ নীতি দেখে এসেছি। অনুগত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্যই যেন বাজেট বরাদ্দ করা হতো। বাজেটে প্রদর্শিত ‘ক্ষুদ্র’ পরিমাণ টাকার দিকে শকুনের লোভাতুর চোখ পড়ে থাকে, তা আমরা বিগত দেড় দশক ধরে দেখেছি।
গত ১৫ বছরে আনুমানিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সরকারি সম্পদ খোয়া গেছে। এর বাইরে অর্থ পাচার, চোরাই কারবার, চাঁদাবাজি, ঘুষ, অবৈধ কমিশন বাণিজ্য, অন্যায্য আর্থিক সুবিধা, ক্রয়-বিক্রয় দুর্নীতি এবং কর ফাঁকির মতো অপরাধের কারণে বাংলাদেশ আরও ৬০ বিলিয়ন ডলার শুধু রাজস্ব হারিয়েছে।
চুরি হওয়া এই অর্থ জনগণের টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ (অনুমিত পরিমাণের যোগফল ১২০ বিলিয়ন ডলার) দিয়ে দেশের সমুদয় বৈদেশিক ঋণ (১০০ বিলিয়ন ডলার) পরিশোধ করা যেত।
এর আরেক মানে দাঁড়ায়, এই ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ১৮ কোটি মানুষের মাথাপিছু ঋণের চেয়ে বেশি এবং এগুলো শত এবং হাজার কোটি টাকার আকারে কারও না কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, দেশ–বিদেশের সম্পত্তিতে বা চোর-ডাকাতের ঘরে ঢুকে পড়েছে।
নব্য স্বাধীন দেশে শেখ সাহেব বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল এনেছিলাম। আমার কম্বল কই?’
আজকের তরুণেরাও তো বলতে পারে লুট হওয়া জাতীয় অর্থ-সম্পদে তাদের ‘ভাগেরটুকু’ গেল কোথায়?
শেখ মুজিবেরই উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা অবশ্য নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ঘটে যাওয়া ব্যাপার নির্দ্বিধায় বলে ফেলেছেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, তাঁর ‘কাজের লোক’ও নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা গত ৫ আগস্ট গণভবন ছেড়ে পালানোর সময় কয়েক শ কোটি টাকার সমমানের মার্কিন ডলার নিয়ে যান বলে কিছু কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
শুনেছি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শাসনামলের প্রথম পাঁচ বছরেই তাঁর দপ্তরের এক দায়িত্বশীল আমলা কামিয়েছিলেন ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাসিনার পতনের পর বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তা দেশ ছাড়ার জন্য ২০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা ‘খরচ’ করেছেন বলেও রটনা আছে।
একদা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের এই টাকা যাঁরা দিয়েছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই বিনা লাভে সম্প্রদান করেননি। দাপ্তরিক কাগজে লিখেও এ লেনদেন করার কথা নয়।
তবে যখন অবকাঠামো নির্মাণে লোহার বদলে বাঁশ ব্যবহৃত হয়, তখন আন্দাজ করা যায়, এই টাকা কীভাবে কার কার পকেটে ঢুকেছে। আওয়ামী ‘সুশাসনে’ পদ্মা সেতুর খরচ তিন গুণ এবং রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে। আদানির বিদ্যুৎ আমদানি মূল্য চড়া হয়েছে।
সেখানেই থেমে থাকেনি দুষ্ট চক্র। শেখ পরিবারের এক আইনজীবী রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ‘জামিন বিক্রি’র অভিযোগ আছে। এবং অতি চালাক আওয়ামী লীগ বিদ্যুৎ খাতে যথেচ্ছাচারে দুর্নীতি নিয়ে ভবিষ্যতে মামলার শঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টাকে অগ্রিম দায়মুক্তি দিয়েছে।
বিগত হাসিনা আমলের প্রথম দিকে হলমার্ক ঋণ জালিয়াতিতে সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকা হারানোর ঘটনায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত বলেছিলেন, এটি অত বেশি পরিমাণ অর্থ নয়। তখন তাঁর কথায় সবাই হতবাক হয়েছিলেন। পরে যখন লাখো কোটি টাকা পাচারের খবর বের হতো শুরু করল, তখন সবাই বুঝল, তিনি ভুল কিছু বলেননি। তিনি বোধ হয় তখনই বুঝেছিলেন, এটা তো সবে শুরু!
সরকারি অর্থ আত্মসাৎ বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে টাকাপয়সা উপার্জন যা-ই হোক, এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন নানা গোষ্ঠীর বেশ কিছু ক্ষমতাকেন্দ্রিক মানুষ।
তাঁরা সবাই মিলে আসলে একটি মাত্র পক্ষ; যাকে বলা হয় মাফিয়া। এই মাফিয়ার একজন ‘কেয়ারিং মাদার’ ছিলেন। উন্নত সংস্কৃতির অনুসারী না হয়েও তাঁরা একেকজন অভিজাততন্ত্র বা অলিগার্কির বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সদস্য। সেটা তাঁরা লুকানওনি।
২০২৪-এর প্রতারণামূলক নির্বাচনের প্রাক্কালে গণমাধ্যমে দেখা গিয়েছিল, এক দল ব্যবসায়ী গলা ছেড়ে স্লোগান দিচ্ছেন, ‘বারবার দরকার, শেখ হাসিনার সরকার।’ এই প্রজাতির ব্যবসায়ী এবং তাঁদের ভাড়াটে নির্বাহীরা প্রায়ই বলতেন, ‘আমরা কর দিয়ে সরকার চালাই।’
যেন চাকরিজীবীরা সেই ট্যাক্স, টোল দেন না এবং মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তরা মূল্য সংযোজন কর দেন না, যা উৎপাদনকারী, সেবাদানকারী ও বিক্রেতাদের দেওয়ার কথা।
পণ্য ও সেবা ভোক্তারা কিনলে তবেই এসব উৎপাদনকারী, সেবাদানকারী ও বিক্রেতাদের লাভের অঙ্ক ভারী হয়—সেটিও তাঁদের খেয়াল থাকে না। কারণ ‘আলীবাবা’র কাহিনিতে চল্লিশ চোরের সর্দার ‘চিচিং ফাঁক’ বললে যেভাবে খাজানার দুয়ার খুলে যেত, তেমনি এই অলিগার্কদের ‘চিচিং ফাঁক’ ধ্বনিতে ভোক্তার অর্থ ‘মূল্য সংযোজন’ রূপে তাদের থলিতে ঢুকত। আর দিন শেষে সেই ‘চল্লিশ চোর’ জনগণের মুখের ওপর ‘আমরাই তো কর দিয়ে দেশ চালাই’ বলে আস্ফালন করতেন।
তাঁদের সেই আস্ফালনের সঙ্গে শেখ হাসিনার ‘আমিই ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়াই’ মন্তব্যের কী অসাধারণ মিল!
সেই ধারায়ই তাঁরা মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে লুটপাটের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কী ‘এল ডোরাডো’ বানিয়ে ফেলেছিলেন বাংলাদেশকে।
হাসিনার শাসনব্যবস্থায় জনগণের অর্থ বাপ–দাদার সম্পত্তির মতো ব্যবহার এবং যাকে খুশি তা উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ায় কোনো বাধা থাকেনি। এর ফল পাহাড় সমান দুর্নীতি, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার এবং দেশ উজাড়।
বাংলাদেশের কোথায় কোন ব্যয়বহুল প্রকল্প নেওয়া হবে অনেক ক্ষেত্রে সে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতো অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন চিন্তাবিদদের জানাশোনার বাইরে। দেশি-বিদেশি দালাল, দলঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, মন্ত্রী ও আওয়ামী আমলাসহ মাফিয়াদের কর্তৃত্বে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো।
বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ সভায় এই লেখককে জিজ্ঞাসা করা হয়, চলমান সংস্কার উদ্যোগ এবং আগামী রাজনৈতিক উত্তরণের আগে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ এবং অংশীজনের করণীয় কী?
এই লেখকের উত্তর ছিল, অবশ্যই প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে পাবলিক মানি-সংক্রান্ত সঠিক তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করে জনগণের ক্ষমতায়ন। সে জন্য গণতন্ত্র থাকতেই হবে।
এ প্রক্রিয়া সহজ করতে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং উপজেলা ও জেলা পরিষদের বাজেটে গণমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত।
আমাদের দেশে নির্বাচিত সংসদের সদস্যরাও সরকারের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রণয়নের যথাযথ সুযোগ পাননি। এ বিষয়ে অনেকের জ্ঞান ও আগ্রহের অভাব থাকায় বাজেট জিনিসটি অতিশয় উচ্চমার্গীয় আমলাতান্ত্রিক চর্চা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই চর্চা থেকে আমাদের বের হতে হবে। বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ হয়ে থাকে তার মালিক যেহেতু জনগণ, সেহেতু বাজেটকে ‘উচ্চমার্গীয় বিষয়’ বানিয়ে রাখা যাবে না। টাকার মালিক যেহেতু জনগণ, সেহেতু কোন খাতে কত খরচ করা হবে, তা মালিককে সহজ ভাষায়, ‘নিম্নমার্গীয়’ ভাষায় বুঝিয়ে দিতে হবে।
এ বিষয়ে সম্ভাব্য আইনপ্রণেতাসহ সব রাজনীতিককে সজাগ থাকতে হবে। বাজেট সম্পর্কে জনগণকে পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। আইনপ্রণেতাদেরও পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে, যাতে তাঁরা জনগণের পক্ষে এসব বিষয়ে কথা বলতে পারেন।
তবে যদি না হাসিনা আমলের ‘অভিজাততন্ত্র’ ভেঙে দেওয়া যায় এবং একই ধরনের গোষ্ঠীর মাথাচাড়া দেওয়া বন্ধ না করা যায়, তাহলে জনগণের অর্থ মেরে দেওয়ার সংস্কৃতি ক্ষমতাসীন বলয়ের লোকদের অধিকার হিসেবেই থেকে যাবে।
সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে হলে এমনভাবে কর নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে জনগণ করদানে উৎসাহী হয়। বেসরকারি খাত বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, যাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা যায়। এর বাইরে ব্যাংক খাত ঢেলে সাজানো এবং পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো উন্নয়ন বন্ধ করার মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসবের কোনোটিই বর্তমান সরকারের একার এবং কেবল এই সময়ের ইস্যু নয়। এগুলো চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়ও নয়। সত্যিকারের জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে সংস্কারে হাত দিলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সাধারণ মানুষের উপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সরকার তথা আমলাতন্ত্র যখন রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে জনগণের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করবে এবং জনগণ যখন সব প্রতিষ্ঠানের ওপর যথার্থ অর্থে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তখনই সর্বাত্মক সংস্কার সর্বার্থে প্রতিভাত হবে।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক