ইউরোপের নেতারা কেন যুদ্ধ চান

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁছবি: এএফপি

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ও ক্ষোভ বেশ কিছুদিন ধরেই বাড়ছে। সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আর তাঁদের নেতারা চাইছেন যুদ্ধ দিয়ে সংকটের মোকাবিলা করতে। এর সংকট আসলে একটা নয়, একাধিক। আর সেগুলো কমার বদলে ক্রমে গভীর হচ্ছে। জীবনযাত্রার সংকট, বাসস্থান সংকট, অভিবাসন সংকট। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে।

আর সর্বোপরি আছে রাজনৈতিক সংকট। দেশে দেশে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান ঘটছে। তাঁরা ভোটে জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট পাচ্ছেন। ইউনিয়নের ঐক্যের বোধ আর উদারনৈতিক মূল্যবোধই এখন হুমকির মুখে।

মাত্র কয়েক দিন আগে, অস্ট্রিয়ার নির্বাচনে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে অতি ডানপন্থী ফ্রিডম পার্টি জিতেছে। যদিও তারা হয়তো অস্ট্রিয়ায় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়তে পারে। তবে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও ডানপন্থীদের উত্থান ঘটেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের মধ্যে ৯টিতে ডানপন্থীরা ক্ষমতায় আছে বা অচিরেই আসবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জটি সম্ভবত প্রতিবেশী ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্রের প্রবাহ অব্যাহত।

যুদ্ধ অর্থনীতির মন্ত্র খুব জোরেশোরে প্রচার করা হচ্ছে। ইউরোপীয়দের বিশ্বাস করানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে যে সামরিক খাতের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় অর্থনীতিকে চাঙা করা সম্ভব। সেপ্টেম্বরে, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী, উদারপন্থী অর্থনীতিবিদ মারিও দ্রাঘি বহুল প্রতীক্ষিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। প্রতিবেদনের বিষয় ইউরোপীয় দক্ষতার ভবিষ্যৎ।

এই যুদ্ধ যে শিগগির থামবে, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কালো ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ঘটছে একের পর আরেক মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এই ক্রমবর্ধমান পাহাড়প্রমাণ সংকটের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া কী?

আশ্চর্যের কিছু নেই যে তাঁরা সংকটে যে সাড়া দিচ্ছেন, তা সমস্যার মূল কারণগুলোকে মোকাবিলা করার ধারেকাছেও যায়নি। তাঁরা খুব আনন্দের সঙ্গে যেসব ধ্বংসাত্মক নব্য উদারবাদী নীতিগুলো গ্রহণ করেছেন, সেগুলো জন্ম দিয়েছে অসংখ্য বিষফোড়া। তাঁরা এখন এই সংকট থেকে পার পাওয়ার জন্য যুদ্ধবাজির আশ্রয় নিতে চাইছেন। হয়তো আশা করছেন যে যুদ্ধের উত্তেজনায় মানুষ তাদের হাতাশা আর ক্ষোভ ভুলে থাকবে।

গত দুই বছরে বারবার শোনা গেছে যে ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি রাশিয়া। আর এর সমাধান হচ্ছে ইউক্রেনে রাশিয়াকে পরাজিত করা। ইউরোপীয় অস্ত্র ইউক্রেনে প্রবাহিত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ধীরে ধীরে আরও মারাত্মক, আরও ধ্বংসাত্মক অস্ত্র বানানোর আওতা বাড়াচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে যে ইউক্রেনকে রাশিয়ার ভূখণ্ডে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে। এই কথা জোর দিয়ে বলছেন ইইউর বিদায়ী পররাষ্ট্র প্রধান জোসেপ বোরেলসহ ইউরোপীয় নেতারা।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহকারী দেশগুলোকে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার জন্য প্রস্তাব পাস করেছে। এ ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়া বারবার সতর্ক করেছে। এমনকি সম্প্রতি রাশিয়া কোন ক্ষেত্রে তার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে, সেই নীতিমালাও বদলেছে।

ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে শুধু তা–ই নয়, একই সঙ্গে তারা তাদের জনগণকে বলছে যে অস্ত্রের জন্য আরও বেশি ব্যয় করতে দেশগুলোকে প্রস্তুত হওয়া দরকার। কারণ, অস্ত্র সরবরাহ করতে করতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আন্দ্রিয়াস কুবিলিয়াস ইইউর প্রতিরক্ষা কমিশনার হিসেবে মনোনয়ন প্রার্থী। ‘রাশিয়ার হুমকি’ মোকাবিলার জন্য এই নতুন পদ তৈরি করা হয়েছে। আন্দ্রিয়াস মনে করেন যে মস্কোকে প্রতিহত করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজেই ‘যুদ্ধ-অস্ত্রের ভান্ডার’ হয়ে ওঠা উচিত।

যুদ্ধ অর্থনীতির মন্ত্র খুব জোরেশোরে প্রচার করা হচ্ছে। ইউরোপীয়দের বিশ্বাস করানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে যে সামরিক খাতের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় অর্থনীতিকে চাঙা করা সম্ভব। সেপ্টেম্বরে, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী, উদারপন্থী অর্থনীতিবিদ মারিও দ্রাঘি বহুল প্রতীক্ষিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। প্রতিবেদনের বিষয় ইউরোপীয় দক্ষতার ভবিষ্যৎ।

প্রতিবেদনে ইউনিয়নের আরও গভীর অর্থনৈতিক একীকরণ করার কথা বলা হয়েছে। অনেকে এর প্রশংসা করেছেন। ইউরোপীয় নেতারা বোধ হয় লাতিন প্রবাদটি খুব পছন্দ করেন, ‘যদি শান্তি চান, তাহলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন’। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে এই প্রবাদ কাজে লাগাতে গেলে সমস্যা আছে। আর তা হলো পারমাণবিক অস্ত্র। একবার সেই অস্ত্রের বোতামে হাত পড়লে মানবসভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে।

যুদ্ধ, যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং যুদ্ধের জন্য অস্ত্র তৈরির বিষয়ে এসব কথা খুব কার্যকরভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক সংকট আর সংকটের মূল থেকে দূরে সরাতে পারছে। মুখে মানবাধিকার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায্যতার কথা বলে ইইউ মূলত একটি নিও লিবারেল প্রতিষ্ঠান। তারা ধনীদের আরও ধনী হওয়ার অধিকার নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সাধারণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও বিকাশ ইইউর উদ্বেগের বিষয় নয়। এ কারণে ইউরোপজুড়ে কল্যাণরাষ্ট্র পিছু হটছে।

  • সান্তিয়াগো জাবালা, দর্শনের অধ্যাপক, ফ্যাবরা বিশ্ববিদ্যালয়, স্পেন

  • ক্লদিও গ্যালো, লা স্ট্যাম্পা পত্রিকার সাবেক বৈদেশিক ডেস্কের সম্পাদক এবং লন্ডন সংবাদদাতা