ফল দেখে বৃক্ষের পরিচয় জানা গেলেও ফলাফল দেখে বাংলাদেশের শিক্ষার বর্তমান হাল বোঝা বেশ জটিল। প্রায় শতভাগ পাস আর জিপিএ–৫–এর ছড়াছড়িতে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘উচ্চফলনশীল’ মনে হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনায় হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। শিক্ষার মান নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের (জিকেআই) ২০২২ সালের তালিকায় ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫তম। এমনকি জিকেআইয়ের বৈশ্বিক গড় স্কোরেরও (৪৬.৫) বেশ নিচে বাংলাদেশের স্কোর (৩৬.৮)। সুতরাং হরেদরে জিপিএ-৫ দেখে যাঁরা ভাবছেন, আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাট বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছি, তাঁরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারেন। শুধু শিক্ষার মান পরিমাপক আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং নয়, দেশীয় মানে পরিচালিত এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে ভর্তি পরীক্ষা, সেখানকার ফলাফলেও জিপিএ-৫–ধারীদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। গত কয়েক বছরে উচ্চ জিপিএ অর্জনকারী অনেক শিক্ষার্থী ওই পরীক্ষাগুলোতে ‘পাস’ মার্ক পর্যন্ত তুলতে পারেনি।
দেশে যে–সংখ্যক শিক্ষার্থী, সে তুলনায় সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কম। ফলে বেসরকারি উদ্যোগে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসবের মধে৵ কতগুলো প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্যে আর কতগুলো স্রেফ ব্যবসার জন্য, সে ব্যাপারে আলাপ হওয়া দরকার। আমাদের দেশের অন্য সব ব্যবসায়ীর মতো ‘শিক্ষা ব্যবসায়ী’রাও ব্যবসার প্রকৃত নীতিনৈতিকতা মেনে চলেন না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা আসলে উপকৃত হয় না। নামমাত্র সার্টিফিকেট তারা পায় বটে, সঠিক শিক্ষাটা পায় না। দেশের প্রতিটি শহরের অলিগলিতে নানা ধরনের স্কুল দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলা, ইংরেজি, আরবি, গান, নাচ, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদির একটি প্যাকেজ মনে হয় এসব বিদ্যালয়কে। শিশুকে যত ধরনের ‘শিক্ষা’ দেওয়া যায়, তারই যেন চূড়ান্ত এগুলো। আমাদের অভিভাবকেরাও ‘একের ভেতরে সব’ পেয়ে ছোটেন বাচ্চাদের এসব স্কুলে ভর্তি করাতে। যে বয়সে শিশুদের শেখার কথা সহযোগিতা, সেই বয়সে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় প্রতিযোগিতা। খোলা মাঠ নয়, ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার ইঁদুর দৌড়ের মাঠে আচমকা এসে পড়তে হয় তাদের। ফলাফলের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লে আবার শিক্ষার্থীদের মা-বাবার ‘ইজ্জত’ থাকে না।
কোমলমতি বাচ্চারা এখন বড় হয় ‘মা-বাবার ইজ্জত বাঁচানো প্রকল্পের’ বিরাট বোঝা মাথায় নিয়ে। শুধু তাই নয়, মাথার বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পিঠেও একটা প্রকাণ্ড বোঝা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ওই বোঝার নাম ‘বইয়ের বোঝা’। সে স্কুলে যত বেশি বই, সেই স্কুল তত ভালো—এমন একটা ধ্যানধারণা নিয়ে বেসরকারি স্কুলগুলোতে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক বই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয়। দেশে সরকারি একটা পাঠ্যক্রম আছে, শিক্ষাক্ষেত্রের অভিজ্ঞ মানুষদের নিয়ে তা তৈরি হয়, বছর বছর পর্যালোচনা, পরিবর্তন, পরিবর্ধনও করা হয়। সেই সিলেবাসের বই ছাড়া ক্লাসে অন্য বই পড়ানো আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি স্কুল কমিটির লোকজন সেটি থোড়াই কেয়ার করে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো বই পড়তে বাধ্য করে শিক্ষার্থীদের। কোনো স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে তিনটি বই, কোনো স্কুলে পড়ানো হয় সাতটি।
বেশি বই পড়ানোতে স্কুলের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির ব্যাপার যেমন থাকে, তেমনি থাকে ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার চেষ্টাও। কোনো কোনো স্কুল সরাসরি বই-খাতা বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকে, বাকিরা বইয়ের দোকানির সঙ্গে কোনো একটা ‘বন্দোবস্ত’ করে নেয়। অনেক সময় ইচ্ছা না থাকলেও অভিভাবকেরা অতিরিক্ত বই ও খাতা কিনতে বাধ্য হন। কিন্তু এনসিটিবির আইনে বলা আছে, ‘বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত ও প্রকাশিত নয় অথবা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অনুমোদিত নয়, এমন কোনো পুস্তককে কোনো বিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না। কেবল সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে কোনো বিদ্যালয় বা কোনো শ্রেণির বিদ্যালয়কে এ ধারার প্রয়োগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ আছে।’
কিন্তু কোনো প্রকার প্রজ্ঞাপন ছাড়া বছরের পর বছর বিদ্যালয়গুলো অতিরিক্ত বই পড়িয়েই যাচ্ছে। শিক্ষাবিষয়ক সব কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে দিনের পর দিন চলছে এসব। আইন আছে প্রয়োগ নেই। কাজির গরুর মতো এসব আইন কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই। কিন্তু এর কারণে ভুক্তভোগী হচ্ছে আমাদের কোমলমতি শিশুরা। আমরা তাদের কাছ থেকে তাদের শৈশব ছিনিয়ে নিচ্ছি। স্কুল শুরু কিংবা ছুটির সময়ে দেখা যায়, বইয়ের ব্যাগের ভারে নুয়ে পড়া ছোট ছোট শিশু অতি কষ্টে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। যারা একেবারে অপারগ বা যাদের সাহায্যকারী আছে, তাদের ব্যাগ বয়সে বড় কারও পিঠে দেখা যায়। ২০১৬ সালে উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেখানে শিশুর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, সব স্কুল এখনো এই নির্দেশ মানে না।
সবচেয়ে নাজুক অবস্থা ঢাকাসহ প্রধান প্রধান শহরের স্কুলগুলোর। গলির মোড়ে মোড়ে চার দেয়ালের মধে৵ গজিয়ে উঠেছে প্রচুর স্কুল। এসব স্কুলে মাঠ তো দূরের কথা, পর্যাপ্ত আলো–বাতাস পর্যন্ত নেই। বাসার চার দেয়াল থেকে বেরিয়ে স্কুলের চার দেয়াল—এই হলো আমাদের শিশুদের চলাফেরা।
মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতাকাহিনী’ গল্পের সেই তোতা পাখির কথা। রাজার নির্দেশে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাকে সোনার খাঁচায় বন্দী করা হয়েছিল। পাখির চেয়ে পাখিকে শেখানোর কায়দাটা এত বড় ছিল যে রাজা পাখিটিকে দেখতেই পাননি। পুঁথির পাহাড়ের আড়ালে পাখিকে দেখতে না পেয়ে বরং খুশিই হয়েছিলেন রাজামশাই।
শিশুদের মানসিক বিকাশ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আমাদের নীতিনির্ধারক ব্যক্তিদের। ফলে বিষণ্নতা ও হতাশাপ্রবণতাই এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন জানাচ্ছে, দেশে গত বছর স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর। এই শিশুদের মধ্যে একটি অংশের আত্মহত্যার কারণ হলো, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া এবং শিক্ষকের দ্বারা অপমানিত হওয়া। এই অচলায়তনের শেষ কোথায়? কত দিন এমন অনিয়মের বোঝা বইতে বাধ্য হবে আমাদের শিশুরা?
মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতাকাহিনী’ গল্পের সেই তোতা পাখির কথা। রাজার নির্দেশে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাকে সোনার খাঁচায় বন্দী করা হয়েছিল। পাখির চেয়ে পাখিকে শেখানোর কায়দাটা এত বড় ছিল যে রাজা পাখিটিকে দেখতেই পাননি। পুঁথির পাহাড়ের আড়ালে পাখিকে দেখতে না পেয়ে বরং খুশিই হয়েছিলেন রাজামশাই। পণ্ডিতেরা পাখিটিকে হাঁ করিয়ে জোর করে পুঁথির পৃষ্ঠা তার মুখের মধ্যে পুরে দিত। অতিরিক্ত শিক্ষার ভার সইতে না পেরে একদিন প্রাণ যায় পাখিটির। আমাদের শিশুদেরও কি আমরা এভাবে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছি না? প্রাণে না মরলেও তারা যে ‘মনে’ মরে যাচ্ছে দিনে দিনে!
মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক