সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হচ্ছে, এই খবরে বেসরকারি খাতের কর্মীদের বক্ষ আবারও দুরুদুরু করতে শুরু করেছে। গত দুই বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির পর এখন সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে যদি আবারও মূল্যস্ফীতি বাড়ে, এই ভয়ে।
সরকার নিজের কর্মচারীদের বেতন বাড়াবে বা তা না পারলে মহার্ঘ ভাতা দেবে, তাতে অন্যদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের মতো দেশে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও অন্যদের বাড়ে না; মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আসে বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
বাজারের ধারণা, দেশের সবাই যেন সরকারি চাকরি করে। সে জন্য যখনই সরকার পেস্কেল বা মহার্ঘ ভাতা দেয়, তখনই বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। অতীতে প্রায় সব সময় এই প্রবণতা দেখা গেছে। এর জন্য অবশ্য পেস্কেল বা মহার্ঘ ভাতা দায়ী নয়, দায়ী বাজার ব্যবস্থা।
বাস্তবতা হলো, গত দুই বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় দেশে যেমন দারিদ্র্য বেড়েছে, তেমনি অনেক সচ্ছল মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হয়েছে। এমনকি কেউ কেউ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন।
সরকারের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সরকারের সব কর্মচারী বাড়ি–গাড়ির ঋণ, মালি ভাতা, বাবুর্চি ভাতা বা বিদেশ সফরের সুযোগ পান না, বা দুর্নীতিও করেন না। তাঁদের জন্য এই মহার্ঘ ভাতা অতীব প্রয়োজনীয়।
গত বছরের শুরুর দিকেও খবর ছড়িয়ে পড়ে যে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু শেষমেশ তা দেওয়া হয়নি, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেতন বাড়ানো হয়। সরকারের পক্ষে থেকে আরও বলা হয়, বেসরকারি খাতের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের কিছু করণীয় নেই।
কারণ, সেটা সরকারের বিষয় নয়। দেশের কর্মশক্তির সামান্য অংশই সরকারি চাকরিতে আছেন, বেশির ভাগই বেসরকারি খাতে। ফলে দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রতি সরকারের দায় থাকবে না, এটা হতে পারে না।
এটাও ঠিক, বেসরকারি খাতের বেতন বৃদ্ধি করা সরকারের সরাসরি কাজ নয়, কিন্তু এই খাতের বেতন-ভাতা ন্যূনতম কত হবে, সে বিষয়ে অনেক দেশেই সরকারের দিকনির্দেশনা থাকে। সেটা মানা হচ্ছে কি না, তাও তদারকি করা সরকারের দায়িত্ব। বাজারব্যবস্থা একেবারে স্বাধীন হতে পারে না, তার ওপর সরকারের একধরনের নিয়ন্ত্রণ সবখানেই থাকে, যদিও আমাদের দেশে সেই নিয়ন্ত্রণ খুবই শিথিল।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষের মধ্যে স্বস্তি আসবে এবং তারা মনে করবে, এই প্রথম কোনো সরকার প্রত্যক্ষভাবে তাদের জন্য কিছু করেছে। সেটাই হবে বৈষম্য হ্রাসের পক্ষে প্রথম পদক্ষেপ, মানুষের মানবিক মর্যাদা ও সাম্য নিশ্চিত করার মোক্ষম হাতিয়ার।
উন্নত দেশে বেসরকারি খাতে মজুরি নির্ধারণে সরকারের ভূমিকা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে একই সঙ্গে হ্যাঁ ও না। হ্যাঁ; কারণ, সরকার ন্যূনতম মজুরি ঠিক করে দেয়। এ ছাড়া ট্রেন, বাস ও মেট্রো কোম্পানিকে ভর্তুকি দেয় এবং বিভিন্ন খাতে কর্মরত কর্মীদের বাধ্যতামূলক সবেতন ছুটি ও পেনশন নিশ্চিত করে। সেই অর্থে সরকার সেখানে পরোক্ষভাবে কর্মীদের মজুরি বা বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করে।
উত্তর আবার না এ কারণে যে একটি কোম্পানি ঠিক কত বেতন বা মজুরি দেবে, সরকার তা সরাসরি নির্ধারণ করে দেয় না। তা নির্ভর করে সেই কোম্পানির ওপর। কিন্তু তা কোনোভাবেই ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম হবে না। মূল্যস্ফীতির হার লাগামছাড়া হয়ে গেলে সরকার আবার ন্যূনতম মজুরির হার সময়-সময় বৃদ্ধি করে। গত কয়েক বছরে উন্নত দেশে তা হয়েছে। আমাদের দেশে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হলে জীবন দিতে হয়। আবার সব খাতে ন্যূনতম মজুরিও নেই। যাঁরা অফিসে ‘ভদ্রলোকের মতো’ কাজ করেন, তাঁদের অবস্থা সম্ভবত সবচেয়ে করুণ। তাঁদের অবস্থা দেখার কেউ নেই। মালিকপক্ষ বেতন বাড়ালে বাড়ে, না বাড়ালে বাড়ে না।
মোদ্দা কথা হলো, উন্নত দেশে যে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে, আনুষ্ঠানিক খাতে তার চেয়ে কম মজুরি দেওয়ার সুযোগ নেই। অনানুষ্ঠানিক খাতে সেই সুযোগ নেওয়া হয়। যদিও বলা বাহুল্য, ওই সব দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতের পরিধি খুবই ছোট। মূলত অবৈধ অভিবাসীরা এসব খাতে কাজ করেন; নিয়োগকর্তারা সেই সুযোগ নেন।
অর্থাৎ পৃথিবীর উন্নত দেশে সরকার সবার কথাই চিন্তা করে—মূল্যস্ফীতি বাড়লে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যাতে মানুষের কিছুটা উপকার হয়। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেলে ইউরোপের অনেক দেশে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বিশেষ ব্যবস্থা বলতে ট্রাকে করে আলু, পেঁয়াজ, ডাল বিক্রি করা—এর বেশি কিছু নয়। এর কারণ অবশ্য আর কিছু নয়, সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতা না থাকা। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত এখন ৭ শতাংশের ঘরে, এত কম রাজস্ব নিয়ে সরকারের পক্ষে বিশেষ কিছু করা সম্ভব নয়।
বিষয়টি হলো, আমাদের দেশের সরকার কখনো বেসরকারি খাতকে মহার্ঘ ভাতা দিতে বা বেতন বৃদ্ধিতে বাধ্য করেনি; এবার অন্তর্বর্তী সরকার যদি সেরকম কিছু করে, তারা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। অন্তত আনুষ্ঠানিক খাতকে মহার্ঘ ভাতা দিতে বাধ্য করতে পারেন তাঁরা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই তা করে থাকে, কিন্তু সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানে তার বালাই নেই। উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন মানুষেরা যেমন আইটি বিশেষজ্ঞ ও হিসাববিদেরা বেসরকারি খাতে উচ্চ আয় করে থাকেন ঠিক, কিন্তু গড়পড়তা মজুরি বা বেতন কম। প্রয়োজন হলো, এই গড় মান বাড়ানো; এটা করা গেলে উৎপাদনশীলতায় বড় পরিবর্তন আসবে বলেই বিশ্বাস করি।
শুধু ডান্ডা মেরে কাজ হবে না। সে জন্য সরকার ঘোষণা দিতে পারে, যেসব প্রতিষ্ঠান ২০ শতাংশ বা তার বেশি মহার্ঘ ভাতা দেবে, তাদের করপোরেট করে কিছুটা ছাড় দেওয়া হবে বা বিদ্যুৎ–জ্বালানিতে ভর্তুকি দেওয়া হবে বা অন্য কোনো সুবিধা দেওয়া হবে।
সমস্যা হলো, অর্থনীতির বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। এদের ওপর নজরদারি করার কোনো মাধ্যম নেই বললেই চলে। কিন্তু সরকার যেটা পারে, তা হলো, বেতন বৃদ্ধি বা মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রয়োজনীয় বাস্তবতা তৈরি করা, যেন এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও মজুরি বাড়াতে বা ভাতা দিতে বাধ্য হয়। সেই সঙ্গে যারা তা দেবে, উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের প্রণোদনা দেওয়া।
সার্বিকভাবে সরকারি-বেসরকারি এমনকি অনানুষ্ঠানিক খাতসহ অর্থনীতির সব ক্ষেত্র ও খাতকে ধীরে ধীরে ন্যূনতম মজুরি এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর মজুরি সমন্বয় করার কাঠামোর ভেতরে নিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, বেসরকারি ও অনানুষ্ঠানিক খাতকে সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আনতে হলে শ্রমবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে ও ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, যাতে বাজারব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে মজুরির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়।
করছাড় দেওয়া হলে সরকারের রাজস্ব আয় কমবে, বিষয়টি মোটাদাগে সে রকম মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো অভ্যন্তরীণ ভোগ বা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এই দুর্মূল্যের বাজারে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে বাজারে বেচাকেনা বাড়বে, তাতে করছাড় দেওয়ার কারণে সরকারের যে রাজস্ব ঘাটতি হবে, তা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা যাবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষের মধ্যে স্বস্তি আসবে এবং তারা মনে করবে, এই প্রথম কোনো সরকার প্রত্যক্ষভাবে তাদের জন্য কিছু করেছে। সেটাই হবে বৈষম্য হ্রাসের পক্ষে প্রথম পদক্ষেপ, মানুষের মানবিক মর্যাদা ও সাম্য নিশ্চিত করার মোক্ষম হাতিয়ার।
প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক