উন্নয়ন প্রচারে প্রকল্প: মালিককে পাত্তা না দেওয়া কর্মচারীর কথা

শাহবাগের সামনে টাঙানো বিলবোর্ডে ঢাকা পড়ে যাওয়া বারডেম হাসপাতালের ভবনের ফাইল ছবি।
ছবি: মনিরুল আলম

গ্রামের এক গৃহকর্তা তাঁর বাড়ির কাজকর্মের জন্য একজন কর্মচারী নিয়োগ দিলেন। মাসিক বেতনের বিনিময়ে কর্মচারী সব রকমের কাজ করে দেন। এই যেমন বাজার করে দেওয়া, বিদ্যুৎ বিল দিয়ে দেওয়া, খেতে কাজ করা লোকজনের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া, গরুর দুধ বা পুকুরের মাছ বিক্রি করা, সর্বোপরি গৃহকর্তার ভালো-মন্দের খোঁজখবর রাখা।

হঠাৎ এক দিন গৃহকর্তা দেখতে পেলেন, কর্মচারী মাইক ভাড়া করে এলাকায় মাইকিং করে বেড়াচ্ছেন, মাইকে উচ্চ আওয়াজে তিনি তাঁর দৈনন্দিন সব কাজকর্মের বিবরণী প্রচার করছেন। তিনি বাজার করেন, খাবার নিয়ে যান, ব্যাংক থেকে বিদ্যুৎ অফিস দৌড়াদৌড়ি করেন—এসব। গৃহকর্তা আরও জানতে পারেন, কর্মচারী মাইক ভাড়া করেছেন তাঁর গরুর দুধ বিক্রি করা টাকা দিয়ে। অর্থাৎ কর্মচারী কী কাজ করেন, সেটি মালিককে তাঁর পকেটের টাকা খরচ করে শুনতে হচ্ছে।
মালিকের অবস্থান থেকে বিবেচনা করলে কর্মচারীর কর্মকাণ্ড কতটা যৌক্তিক, ন্যায়সংগত ও সুস্থ?

আরও পড়ুন

দৈনিক প্রথম আলোতে ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর সরকারের ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’ প্রচারে ৪৯২টি উপজেলায় একটি করে এলইডি ডিসপ্লে বসাতে চায়, যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩২ কোটি টাকা। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে দেশজুড়ে প্রচার করে তথ্য মন্ত্রণালয় খরচ করেছে ১০৭ কোটি টাকা, একইভাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করছে, যে প্রকল্প শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে, যাতে খরচ হবে ২১ কোটি টাকা। এই ২৬০ কোটির পুরোটাই জনগণের করের টাকা।

ক্ষমতাসীন দলের প্রথম পরিচয় তারা একটা রাজনৈতিক দল। প্রশ্ন হচ্ছে, একটা রাজনৈতিক দল তার নিজস্ব প্রচার-প্রচারণার জন্য কেন জনগণের টাকা খরচ করবে? আর তা ছাড়া উন্নয়নের সাক্ষী তো উন্নয়ন নিজেই, তা কেন জনগণকে তার পকেটের টাকা খরচ করে শুনতে হবে? এ রকম প্রকল্প যখন অনুমোদনের জন্য আসে, সরকারি দলের কারোরই মাথায় কি এই প্রশ্ন আসে না, কেন আমরা জনগণের টাকা নিজেদের কাজে ব্যবহার করব? নাকি ভগবান দশ চক্রে ভূত হয়ে গেছেন?

কর্মচারী ভুলে গেছেন গরু এবং গরুর দুধের মালিক কে। তাঁর নিজেকে ভালো কর্মী হিসেবে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে তুলে ধরতে হবে, প্রয়োজনে মালিককে দেউলিয়া করে হলেও। কর্মচারী দেখাতে চান, মালিককে তিনি থোড়াই ভয় পান, থোড়াই গ্রাহ্য করেন।

যদি ধরেও নিই অর্থনীতির অবস্থা খুব খারাপ নয়, অন্তত এটা আমাদের মিতব্যয়ী হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সরকার ব্যয় সংকোচনের অনেক পরিকল্পনা করলেও বাস্তব চিত্র যেন উল্টো। দেখা যাচ্ছে, সরকারি আমলা তাঁর অবসরের কয়েক দিন আগে বিদেশ সফর দিয়ে আসছেন, বৃক্ষমেলায় অংশ নিতে বিদেশ যাচ্ছেন দল ধরে, দলীয় বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অবস্থাদৃষ্টে এটা বলা ভুল হবে না, সরকার জনগণের টাকাকে তাদের নিজ দলের টাকা ভাবতে শুরু করেছে, এই ব্যয়ের উৎসের যৌক্তিকতা নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই।

কর্মচারী ভুলে গেছেন গরু এবং গরুর দুধের মালিক কে। তাঁর নিজেকে ভালো কর্মী হিসেবে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে তুলে ধরতে হবে, প্রয়োজনে মালিককে দেউলিয়া করে হলেও। কর্মচারী দেখাতে চান, মালিককে তিনি থোড়াই ভয় পান, থোড়াই গ্রাহ্য করেন।

  • যোবায়ের মাহমুদ উন্নয়নকর্মী
    [email protected]