আমাদের স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে যে সেবাগুলো দেয়, সেটা হাতে গোনা যায়। আইনে উনচল্লিশটা সেবা তালিকাবদ্ধ থাকলেও জন্মনিবন্ধনসহ বিবিধ সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, ভিজিএফ সাহায্য বিতরণ, ত্রাণ বিতরণ, গ্রাম পুলিশ ও সালিস বাদে আর কোনো সেবা ইউনিয়ন পরিষদের সীমিত লোকবল দিয়ে নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।
আধুনিক নাগরিক জীবনে রাষ্ট্র প্রকৃতির মতো একটা অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা বলে বিবেচিত। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে এই রাষ্ট্র আমরা তৈরি করেছি আমাদের কিছু সেবা নিশ্চিত করার জন্য। সে জন্য রাষ্ট্রের সাফল্যের মাপকাঠি হলো সীমিত সম্পদের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার ওপর। সেই সেবা এখন কেন্দ্র না স্থানীয়—কোন সরকার থেকে দিলে সাশ্রয় হয়, সেটা নিয়ে আমাদের আলাপ তুলতে হবে।
আমাদের কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত সরকার তার নাগরিকদের ওপর করের বোঝা বাড়িয়েই চলেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারের বাজেট ছিল ১ লক্ষ তিরিশ হাজার কোটি টাকা আর গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এসে সেই বাজেট দাড়িয়েছে ৭ লক্ষ নব্বই হাজার কোটি টাকায়। বাজেট যত বড় হয়েছে, খরচের হিসাব তত অস্বচ্ছ হয়েছে।
যেখানে আমাদের মূল প্রশ্ন হওয়ার কথা সরকার যে পরিমাণ খরচ করল, সেই পরিমাণ সেবা আমরা পেলাম কি না, সেখানে বাজেটের পরদিন পত্রিকার খবর সীমাবদ্ধ থাকে বাজেট বরাদ্দের বেচে যাওয়া অংশের ওপর। সেবার পরিধি বা মান বাড়ানোর প্রশ্ন পত্রিকার পাতায় উঠে আসে না।
রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো এককেন্দ্রিক হলে কেন্দ্রীয় সরকার সবার জন্য মৌলিক সেবা নিশ্চিত করার বদলে বিশাল বিশাল প্রকল্পে জনগণের দেওয়া সম্পদ খরচ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাস করা নাগরিকদের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া, সরকারের বিবেচনায় উঠে আসে না। রাজধানী তখন হয়ে ওঠে বাজেট বরাদ্দের মূল কেন্দ্র। প্রান্তে প্রান্তে প্রকল্প বরাদ্দ যাও থাকে, সেই সিদ্ধান্ত যেহেতু রাজধানীতে বসে নেওয়া হয়, বরাদ্দের একটা বিরাট অংশ কেন্দ্রেই সিস্টেম লস হিসাবে রয়ে যায়।
রাষ্ট্রক্ষমতা কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ হলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহারের আশঙ্কা কমে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্থান আর প্রকল্পের স্থান কাছাকাছি হলে একদিকে যেমন প্রকল্পের মান ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, তার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের খরচের হিসাব নেওয়ার সুযোগও বাড়ে।
দেশের নাগরিকদের কাছে মৌলিক সেবা পৌঁছে দিতে একদিকে যেমন ভালো প্রশাসন প্রয়োজন, অন্যদিকে সেবার মান নিশ্চিত করতে নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণও অপরিহার্য। রাষ্ট্রীয় সেবার সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে পারলে নাগরিকদের মধ্যে ঐক্যের আবহ সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক চর্চার ভিত্তি হয়ে ওঠে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে উঠতে পারেন।
স্বনির্ভর ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চালু হলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং জনগণের দূরত্ব কমতে থাকে। তখন স্থানীয় প্রশাসন কেন্দ্রীয় শাসনের আঞ্চলিক শাসকের বদলে জনগণের দক্ষ সেবকের দায়িত্ব নিতে শুরু করে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরু থেকেই সাংবিধানিকভাবেই রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান রাষ্ট্রের সর্বস্তরের সর্বময় ক্ষমতা উপভোগ করে এসেছেন। বাংলাদেশের এই সাংবিধানিক বাস্তবতায়, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বাইরে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। স্বশাসিত স্থানীয় সরকার হতে পরে সেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যা নির্বাহী প্রধানের ক্ষমতার বাইরে থেকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য হিসাবে কাজ করতে পারে।
উঁচু মনের মানুষেরা সমাজে ফিরে এলে স্থানীয় সমাজের গুণমান অনেক বেড়ে যাবে। তার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে দক্ষ পেশাজীবীদের জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ফেরত আনতে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মান রাজধানীর পর্যায়ে নিয়ে আসার দৃঢ়সংকল্প আমাদের নিতে হবে।
ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে চলমান সংস্কার আলাপে নাগরিকদের স্থানীয় সরকারের নতুন স্বরূপ নিয়ে আলাপ শুরু হওয়া প্রয়োজন।
প্রথমে আমাদের ভাবতে হবে নাগরিকদের কোন কোন সেবা স্থানীয় সরকারের হাতে থাকলে নাগরিকেরা সর্বোচ্চ মানের সেবা পেতে পারেন। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা এভাবেও ভাবতে পারি যে কোন কোন সেবা কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া ছাড়া সম্ভব নয় বা কেন্দ্রীয়ভাবে দিলেই সবচেয়ে মানসম্পন্ন হয়।
সহজ হিসাবেই আমরা বুঝি প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, বড় অবকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন, আইন প্রণয়ন, পরিকল্পনা এবং মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত। বিচারব্যবস্থা জনগণের সুবিধার জন্য একদিকে যেমন কাছাকাছি দূরত্বে রাখা প্রয়োজন, আবার অন্যদিকে উচ্চ আদালতকে দক্ষ রাখতে প্রান্তিক পর্যায়ে রাখাও অবাস্তব। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতকে বর্তমান ব্যবস্থায় রাজধানী থেকে সরিয়ে, বিভাগীয় সার্কিটে রাখতে পারলে নাগরিকদের পক্ষে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার সুবিধা দেওয়া যায়। ওপরের খাতগুলো ছাড়া বাকি সব রাষ্ট্রীয় সেবা জেলা এবং তার নিচের পর্যায়ে রাখাটাই জনসাধারণের জন্য মঙ্গলজনক।
আমাদের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে অবকাঠামো তৈরি করতে আমরা অনেক সম্পদ ব্যয় করেছি। তার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের রাষ্ট্রভাবনায় জেলা ও উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এই বাস্তবতায় স্থানীয় সরকারকে জেলা, উপজেলা\পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের কাঠামোকে জারি রেখেই চিন্তা করা যায়। সে ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ে আমরা কোন দায়িত্ব অর্পণ করতে পারি, সেটা নির্ভর করবে সেই পর্যায়ের সম্ভাব্য দক্ষতার ওপর।
উদাহরণ হিসেবে আমরা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলোচনা করতে পারি। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে টারশিয়ারি হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ জেলা পর্যায়ের নিচে রাখার যৌক্তিকতা নেই। কারণ, সেই হাসপাতাল চালাতে যে দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন, সেটা জেলা পর্যায়েই তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু উপজেলা হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও এবং ভর্তি রোগীদের সেকেন্ডারি চিকিৎসা দেওয়ার দক্ষতা উপজেলা পর্যায়ে দেওয়া সম্ভব। মাতৃমঙ্গল এবং পাবলিক হেলথের প্রোগ্রাম আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে থেকেই দিতে পারব।
স্বাস্থ্য খাতের মতো শিক্ষা খাত নিয়েও আমরা একই চিন্তা করতে পারি। ইউনিয়ন পর্যায়ে হাইস্কুল, মাদ্রাসা আর কারিগরি শিক্ষা, উপজেলা পর্যায়ে কলেজ এবং ভকেশনাল ট্রেনিং কলেজ এবং জেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর সম্ভাব্য দক্ষতা আমাদের আছে। রাজধানীতে জীবিকার আধিক্য আমাদের আঞ্চলিক সক্ষমতাকে ক্রমশ দুর্বল করেই চলেছে। আমাদের সক্ষমতাকে দেশের সব প্রান্তে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে স্থানীয় সরকারের এই মডেল কাজ করতে পরে।
আবশ্যক নাগরিক সেবার মধ্যে পুলিশ জনঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান বলে সেটা জাতীয় পর্যায়ে রাখার কোনো কারণ নেই। জাতীয় পর্যায়ে থাকার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। পুলিশের দক্ষতাকে স্থানীয় পর্যায়ে রাখলে সেবার মান অনেক বেড়ে যাবে। পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জেলা সংসদের জবাবদিহির ভেতর নিয়ে আসতে হবে।
ঠিক একইভাবে স্থানীয় সরকারের হাতে অদক্ষ এবং অপচয়কারী মন্ত্রণালয়গুলো দায়িত্ব অর্পণ করলে সেবার মান বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। সমাজকল্যাণ, কৃষি, স্থানীয় অবকাঠামো নির্মাণ, শিল্প ও বাণিজ্য, খাদ্য, পরিবেশ, ভূমি, গৃহায়ণ, ধর্ম, শিশু ও মহিলা, যুব ও ক্রীড়া, পর্যটন, পরিবেশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি—এসব কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাখার কোনো বাস্তব কারণ নেই। সেবার মান, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি বিচার করলে এসব মন্ত্রণালয় জেলা সরকারের হাতেই থাকা প্রয়োজন।
একটা ন্যায্য প্রশ্ন উঠতে পারে যে এত এত মন্ত্রণালয় চালানোর জন্য দক্ষ জনবল তো জেলা সরকারের নেই। এর সমাধান হচ্ছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের আদলে প্রতিটি জেলার সিভিল সার্ভিস ক্যাডার তৈরি করতে হবে। জেলা সিভিল সার্ভিস তৈরির সময় বর্তমানে নিয়োজিত প্রশাসনকে জেলা সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে।
আমাদের সমাজে আঞ্চলিক টান প্রবল। সে জন্য নিজের দেশের বাড়ির কাছাকাছি থেকে চাকরি করার সুযোগ অনেকেই লুফে নেবেন। উঁচু মনের মানুষেরা সমাজে ফিরে এলে স্থানীয় সমাজের গুণমান অনেক বেড়ে যাবে। তার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে দক্ষ পেশাজীবীদের জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ফেরত আনতে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মান রাজধানীর পর্যায়ে নিয়ে আসার দৃঢ়সংকল্প আমাদের নিতে হবে।
স্থানীয় পর্যায়ে কাজের পরিধি বাড়লে বেকার যুবসমাজকে আমরা দেশের কাজে নিয়োগ দিতে পারব। সবাইকে নিয়ে একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ আমরা শুরু করতে পারব।
এই স্থানীয় সরকার প্রশাসন জবাবদিহি করবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে। জেলা সংসদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচিত হবে সরাসরি নির্বাচনে। উপজেলা পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি থাকলে জেলা প্রতিনিধির সঙ্গে দায়িত্বের সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্বের আশঙ্কা থাকায় দুই পর্যায়ের নির্বাচিত পরিষদ থাকাই কার্যকর। উপজেলা প্রশাসন জেলা সংসদের এখতিয়ারেই কাজ করবে। ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা প্রশাসনের সেবার জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। ক্ষমতার একটা ভারসাম্য সৃষ্টি হবে।
স্থানীয় সরকার নিয়ে আরেকটা বড় প্রশ্ন হলো এই বর্ধিত দায়িত্বের সরকার চালানোর অর্থ কোথা থেকে আসবে।
এর উত্তর হচ্ছে জাতীয় রাজস্বের একটা বড় অংশ সাংবিধানিক বন্দোবস্তে জেলা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। নাগরিকদের সেবার জন্যই যেহেতু সরকার, সেহেতু রাজস্ব সেখানেই খরচ হবে, যেখানে নাগরিক তার সেবা পায়। কেন্দ্র যাতে কোনোভাবেই এই রাজস্বের হিস্যায় হাত দিতে না পারে, সে জন্য স্থানীয় সরকারের তহবিল সাংবিধানিকভাবে জাতীয় বাজেটের বাইরে রাখা হবে এবং একটা পূর্বনির্ধারিত হারে জেলা সরকারের তহবিলে জমা হবে। জাতীয় রাজস্বের যেসব খাত জেলা পর্যায় থেকে উঠে আসে, সেগুলো জেলা পর্যায়ে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ভূমি রাজস্ব, ভূমি হস্তান্তর শুল্ক, ভ্যাট এবং আয়করের একটা অংশ জেলা সরকারের কোষাগারেই জমা হবে। কাস্টমসের শুল্ক বা সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে যে শুল্ক ও কর কেন্দ্রীয় সরকারের কোষাগারে জমা হয়, সেটাও এই জেলাওয়ারি বাঁটোয়ারার হিসাবে আসবে।
আমাদের সংবিধান স্থানীয় সরকারকে স্থানীয় শাসন নামে বিধিবদ্ধ করেছে, যার ফলে সেটা কার্যত কেন্দ্রীয় শাসনের স্থানীয় শাখা হিসেবেই কাজ করে এসেছে। স্থানীয় সরকার সংস্কারের যে সুযোগ আমাদের হাতে এসেছে, এই সময় ক্ষমতাকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নাগরিকদের জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসতে স্থানীয় সরকার সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে পারে। সে জন্য আমাদের স্থানীয় সরকার পুনর্গঠন নিয়ে বৈপ্লবিক চিন্তাই করতে হবে।
সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন রাজনৈতিক কর্মী, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন