ছাত্রলীগ কখন শিরোনাম হয়, কখন শিরোনাম হয় না। এই যে কয়েক দিন আগে দেশের উত্তরাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেল, গরিব মানুষ শীতে কষ্ট পেয়েছেন, এখনো পাচ্ছেন, ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের কিন্তু খুব দেখা যায়নি তাঁদের পাশে। বিভিন্ন দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শীতার্ত মানুষের মধ্যে কম্বল বিলি করা হয়েছে। কিন্তু সরকার–সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির সে রকম তৎপরতা দেখিনি। তৎপরতা থাকলে পত্রিকার শিরোনাম হতো।
কিন্তু যেখানে অঘটন ঘটে, সেখানেই ছাত্রলীগের নাম আসে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম চার দিনে ছাত্রলীগ নিয়ে চারটি খবর এসেছে প্রথম আলোয়। তার মধ্যে একটি হত্যার, একটি ধর্ষণের।
সর্বশেষ খবরটি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর বহিরাগত বন্ধু মামুনুর রশিদের সহযোগিতায় এক দম্পতিকে ক্যাম্পাসে ডেকে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রাখেন। পরে মোস্তাফিজুর ও মামুন মিলে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন।
পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে একই বাসায় পাশাপাশি কক্ষে ভাড়া থাকতেন ওই দম্পতি ও মামুনুর রশিদ। শনিবার মুঠোফোনে মামুন প্রথমে ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে ক্যাম্পাসে আসতে বলেন, পরে তাঁকে দিয়ে তাঁর স্ত্রীকেও সেখানে আসতে বলেন। রাত ৯টার দিকে ওই নারী ক্যাম্পাসে আসেন। সে সময় ভুক্তভোগীর স্বামী, মামুন, মোস্তাফিজুর ও মুরাদ নামে অরেক ছাত্র মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে আসেন। একপর্যায়ে মুরাদ ভুক্তভোগীর স্বামীকে হলের এ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে নিয়ে বেঁধে ফেলেন ও মারধর করেন। পরে মোস্তাফিজুর ও মামুন ওই নারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলসংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ওই নারী ও তাঁর স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এই ঘটনায় পুলিশ ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আদালত তাদের রিমান্ড দিয়েছে। মামুন পলাতক আছেন। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তাঁরা ‘ক্যাম্পাসে ধর্ষক কেন, প্রশাসন জবাব চাই’; ‘ধর্ষণমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’; ‘ধর্ষকদের পাহারাদার, হুঁশিয়ার সাবধান’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় নেতৃত্ব বরাবর যে কাজটি করে থাকে, এরকম অপকর্মের দায়ে সংগঠেনর কেউ অভিযুক্ত হলেই তাকে সামায়িক বহিষ্কার করে দায়মুক্তি নেওয়ার চেষ্টা করে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও হয়তো ভিন্ন কিছু হবে না। কিন্তু দায় এড়াতে চাইলেই কি দায়মুক্ত হওয়া যায়? ইতিহাস তা বলে না।
পাঠকের মনে থাকার কথা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নব্বই দশকের শেষার্ধে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। সে সময় ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণে সেঞ্চুরি করার অভিযোগ আসে এবং তিনি বিদেশে পালিয়ে যান।
দ্বিতীয় ঘটনা কুষ্টিয়ার। পদ্মা নদীর চরে মিলন হোসেন (২৭) হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এস কে সজীব। তিনি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি (বহিষ্কৃত)। পুলিশের তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং-প্রধান। এস কে সজীবের নেতৃত্বে কুষ্টিয়া শহরে একটি গ্যাং চলে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কিশোর গ্যাং চালান! বর্তমানে এস কে সজীব জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাতের (তুষার) সঙ্গে থেকে রাজনীতি করেন। যদিও তাঁর কোনো পদ নেই।
শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সদর উপজেলায় পদ্মা নদীর চর থেকে নিহত মিলন হোসেনের লাশের ৯ টুকরা চারটি স্থান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তারা জানায়, চাঁদার দাবিতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এস কে সজীবের নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড ঘটে। পুলিশ তাঁকেসহ চারজনকে শহর থেকে আটক করে হেফাজতে নেয়। অন্য তিনজন হলেন সদর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর গ্রামের জহির রায়হান ওরফে বাবু, সদরের কুমারগাড়া এলাকার ফয়সাল আহমেদ, হাউজিং এলাকার ইফতি খান।
এস কে সজীব কলেজে পড়ালেখা না করেও ছাত্রলীগের নেতা হয়েছিলেন। এ রকম আরও কত অছাত্র আছেন ছাত্রলীগে তার খোঁজ কে রাখেন। শোনা যায়, একশ্রে্ণির ছাত্রলীগ নেতা টাকা পেলেই দল ভারী করতে কমিটিতে নাম ঢোকান। তারা ছাত্র হোন বা না হোন। ইয়াসির আরাফাত ও সাদ আহাম্মেদের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে ২০১৭-১৮ সালের দিকে প্রথম সহসম্পাদকের পদ পান সজীব। তখন থেকেই শহরের হাউজিং এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি করে এলাকায় চাঁদাবাজি, মারপিট, মাদকের কারবারসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন। এরপরও নেতাদের সুপারিশে জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়ে যান তিনি। পরে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজ চ্যালেঞ্জের ওপর হামলাসহ নানা অপকর্মের কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এটি এক জেলার কাহিনী। প্রতিটি জেলায়ই সজীবেরা আছেন। থাকবেন। ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা না থাকায় তারা দল বদল করবেন না।
সজীবের নামে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মাদক, চাঁদাবাজি, হামলাসহ নানা অভিযোগে পুরোনো সাতটি মামলা আছে। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরের মামলায় তাঁর দুই বছরের সাজাও হয়েছিল। সরকার বিএনপি নেতা–কর্মীদের দ্রুত বিচার আইনে বিচার করে জেল দিয়েছে। কিন্তু সজীবেরা জেলখানার বাইরেই থাকেন। সাজা হলেও তারা জামিন পেয়ে যান।
দায় কার?
ভাগ্যিস জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে কোনো মিছিল হয়নি। নব্বইয়ের দশকে ধর্ষকদের পক্ষেও মিছিল হয়েছিল। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারীদের শায়েস্তাও করেছেন তারা প্রশাসনের সহায়তায়। এবারে ধর্ষণকা্রীর বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। প্রশাসনও অপরাধীদের ধরতে সহায়তা না করে পুলিশকে সহায়তা করেছে। জানিনা অভিভাবক দলের কেউ আবার একে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত না করেন।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় নেতৃত্ব বরাবর যে কাজটি করে থাকে, এরকম অপকর্মের দায়ে সংগঠেনর কেউ অভিযুক্ত হলেই তাকে সামায়িক বহিষ্কার করে দায়মুক্তি নেওয়ার চেষ্টা করে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও হয়তো ভিন্ন কিছু হবে না। কিন্তু দায় এড়াতে চাইলেই কি দায়মুক্ত হওয়া যায়? ইতিহাস তা বলে না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক