১৯৪৯ সালে বিপ্লবের পর চীন কয়েক দশক সমাজতান্ত্রিক নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতি, হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পর কী করে আশির দশক থেকে বাজার অর্থনীতির সর্বাধুনিক ব্যবস্থাপনা, হিসাবপদ্ধতি ও নীতিমালা আয়ত্ত করে ফেলল, তা এক বড় বিস্ময়ের বিষয়ই বটে। শুধু আয়ত্তই নয়, পুরোনো এবং প্রভাবশালী পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করে নিজেদের অর্থনীতি সংস্কার করে পাল্লা দিয়ে দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিত করল।
বার্ষিক জিডিপির সরল হিসাবে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি—এর পরিমাণ প্রায় ১৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় এই হিসাবে প্রায় ১২ হাজার মার্কিন ডলার। আর যদি অর্থনীতির তুলনামূলক ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে এখন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি, এর আকার সেই হিসাবে প্রায় ২৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার—মাথাপিছু আয় প্রায় ১৯ হাজার মার্কিন ডলার। এগুলো সবই চীন সরকার ও আইএমএফের হিসাব।
মোট আয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকলেও মাথাপিছু আয়ে চীন প্রায় ৮০টি দেশের পেছনে, পিপিপির হিসাবে ৭২টি দেশের পেছনে। সর্বোচ্চ জনসংখ্যা এর একটি কারণ। বিশ্ববাণিজ্যে চীন এখন বৃহত্তম। এর পরিমাণ প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বাজার দখলের জন্য দুর্নীতি, নিম্নমানের পণ্য এবং দাম কমিয়ে বাজার ছেয়ে ফেলার বদনাম চীনের প্রায় সব দেশেই; বাংলাদেশেও কম নয়।
আসলে ধনী ও গরিব বৈষম্য এখন ১৯৪৯ সালে বিপ্লব-পূর্ব চীনের বৈষম্যের চেয়েও বেশি। বেকারত্বের হারও বেড়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় ১২ কোটি মানুষ এখন গ্রাম থেকে উপকূলীয় এলাকায় কাজের সন্ধান করছেন। এর আরেকটি দিক হলো ১৯৯৮ থেকে চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই হয়েছেন প্রায় ৪ কোটি মানুষ। শহরাঞ্চলে এখন বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ পার হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে চীন এখন বৃহত্তম—৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। বিদেশি বিনিয়োগ অন্তঃপ্রবাহেও চীন বৃহত্তম—১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। বিদেশেও চীনের বিনিয়োগ ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন বিদেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিনে ফেলার ঘটনাও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলে সেদিনের বৃহৎ তেল কোম্পানিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এত দিনে চীনের মালিকানায় চলে যেত।
চীন কীভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করল এবং এত বছর তা ধরে রাখতে পারল, কীভাবে এত দ্রুত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হলো, কীভাবে এত বড় দেশে বাজার অর্থনীতিমুখী সংস্কার কোনো বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করল না, তা অর্থশাস্ত্র এবং অর্থনীতিবিষয়ক সব গবেষণা ও নীতিনির্ধারণী আলোচনাতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। বিশ্বের মহাজন শক্তিগুলো এভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চায় যে ওয়াশিংটন ঐকমত্য বা নয়া উদারতাবাদ বা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ নির্দেশিত পথে অর্থনীতির উদারীকরণ বা ব্যক্তি পুঁজির অবাধ বিকাশই এই দ্রুত প্রবৃদ্ধি সম্ভব করেছে। এখানেই প্রশ্ন।
কারণ, বিশ্বব্যাংকীয় মডেল তো বিশ্বের বহু দেশেই অনুসরণ করা হয়েছে, কিন্তু আর বহু দেশে এই একই রকম ফলাফল দেখা যায়নি। আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার বহু দেশ, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ মডেলে নয়া উদারবাদী বাজারমুখী সংস্কারের পথে গেছে। ফলাফলে অনেক ধরন আছে। বহু দেশ হোঁচট খেয়েছে, বহু রকম সংকটে হাবুডুবু খেয়েছে। বিপর্যয়ে ঋণগ্রস্ততা, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, বৈষম্যসহ বিভিন্ন মাত্রার সংকট বেড়েছে। চীনের ক্ষেত্রে বড় সংকট বা বিপর্যয় দেখা গেল না কেন? বস্তুত বিভিন্ন দেশে মোটাদাগে পুঁজিপন্থী সংস্কারের মধ্যেও দুটি ধারা দেখা যায়।
এই দুটির তুলনামূলক চিত্র নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতি বিশ্লেষক কাভালজিৎ সিং গবেষণা করেছেন। অন্য বহু দেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সংস্কারের মৌলিক ভিন্নতার কারণে কাভালজিৎ ‘ওয়াশিংটন ঐকমত্য’ থেকে আলাদা করে একে ‘বেইজিং ঐকমত্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সামগ্রিক তথ্য-উপাত্ত থেকে চীনা মডেলের বৈশিষ্ট্যগুলো এভাবে চিহ্নিত করা যায়:
প্রথমত, ১৯৭৮ সালে যখন চীন অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করে, তত দিনে তার অনেক শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। এর আগে বিপ্লবের পরই চীনের ভয়াবহ দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছিল। সেই ধারায় শিক্ষা ও চিকিৎসা, যোগাযোগ, প্রতিষ্ঠানসহ অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চমাত্রার সাফল্য ছিল। এসব সাফল্য পুরোপুরি নষ্ট করে নয়, বরং এগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, অন্য বহু দেশে, যেমন ভারত, পাকিস্তান বা ব্রাজিলে এসব সংস্কার শুরু হয়েছে একেকটি অর্থকরী সংকটের মধ্যে (ঋণ, মুদ্রামান, লেনদেনের হিসাব ইত্যাদি)। এসব সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে সংস্কারের নানা কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু চীন কোনো অর্থকরী সংকটের চাপের কারণে সংস্কার শুরু করেনি, করেছে সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তায় উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে, বিশ্বশক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। এ রকম নিজস্ব পরিকল্পনা ও কর্তৃত্ব অন্য দেশগুলোর সংস্কারের বেলায় দেখা যায়নি। এখানে তাই অন্য দেশগুলোর মতো বিশ্বব্যাংক–আইএমএফের কোনো ভূমিকা বা কর্তৃত্ব ছিল না। সে কারণে করণীয়, গতি, অগ্রাধিকারে কোনো অসামঞ্জস্য তৈরি হয়নি।
তৃতীয়ত, চীন ধাপে ধাপে পরিকল্পিতভাবে সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। প্রথমে কৃষি, পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং শেষে শিল্প। পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তি খাতের প্রসার ঘটানো হলেও অর্থকরী খাতের ওপর প্রধানত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা হয়েছে। যে কারণে ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থকরী খাতে ধস নামলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ফাটকাবাজারি দ্বারা চীন কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি।
চতুর্থত, প্রথমবারে পুরো দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার বা ব্যক্তি খাতের প্রসার কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছে চীন। যেমন উপকূলীয় ও পূর্ব চীন এলাকায় বিনিয়োগ, করব্যবস্থার সংস্কার সীমিত রাখা হয়েছে শুধু কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে।
পঞ্চমত, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে যেভাবে কোনো রকম আইনি সুরক্ষাব্যবস্থা না রেখে, তুচ্ছ দামে কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিতরণ করা হয়েছে, যার ফলে মাফিয়া পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটেছে, চীনে সে রকম ঘটনা ঘটেনি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে ধাপে ধাপে সংস্কার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের হাতেই রাখা হয়েছে।
ষষ্ঠত, বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ অনেক বেড়েছে চীনে। কিন্তু অন্য অনেক দেশের মতো তা বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য বাড়াতে পারেনি। প্রথম দিকে বিদেশি বিনিয়োগ গ্রহণ করা হয়েছে শুধু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে হংকং ও তাইওয়ানে প্রবাসী চীনাদের থেকে। এ এলাকার বাইরে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর বহু রকম নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়েছে।
তবে অনেক রকম সতর্কতা, নিয়ন্ত্রণ এবং সাফল্য সত্ত্বেও চীনে পুঁজিমুখী সংস্কারের অপরিহার্য অভিঘাত ঠিকই দেখা গেছে। গ্রাম–শহর ও শ্রেণিগত বৈষম্য, বেকারত্ব, দুর্নীতি, সম্পদ কেন্দ্রীভবন, পরিবেশদূষণ তার অন্যতম। বৈষম্যের বিভিন্ন দিক থেকে চীনের পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে দ্রুত। চীনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলে দেশের বিনিয়োগের বড় অংশ গেছে, আঞ্চলিক বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, শহরে মাথাপিছু বার্ষিক আয় যেখানে বেড়েছে শতকরা ৮ দশমিক ৫ হারে, সেখানে গ্রামে তা বেড়েছে শতকরা ৪ দশমিক ২ হারে।
আসলে ধনী ও গরিব বৈষম্য এখন ১৯৪৯ সালে বিপ্লব-পূর্ব চীনের বৈষম্যের চেয়েও বেশি। বেকারত্বের হারও বেড়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় ১২ কোটি মানুষ এখন গ্রাম থেকে উপকূলীয় এলাকায় কাজের সন্ধান করছেন। এর আরেকটি দিক হলো ১৯৯৮ থেকে চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই হয়েছেন প্রায় ৪ কোটি মানুষ। শহরাঞ্চলে এখন বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ পার হয়েছে।
তবে বিপ্লবের ধারায় গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পার্টি–কাঠামো, বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মত ও সিদ্ধান্ত প্রকাশের পাশাপাশি সক্রিয়তার সুযোগ এখনো অনেকখানি অব্যাহত রাখায় রাষ্ট্রীয় নীতিমালা অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রদবদলের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কার্যকর আছে এখনো। উন্নয়ন নামের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক, এমনকি প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটছে।
● আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক