কয়েক মাস ধরে ভিয়েতনামের ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম সারির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে গদি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং দেশটির সাবেক পুলিশপ্রধান তো লাম নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন।
এ অবস্থায় যে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ভিয়েতনামকে একটি আকর্ষণীয় বাজার এবং চীনের বিকল্প ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে, তাদের হুঁশিয়ার হওয়া দরকার। কেননা, দেশটির নেতৃত্বের এই পরিবর্তন কোনো আশাবহ আভাস দিচ্ছে না; বরং লামের ক্ষমতায় আরোহণ থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ভিয়েতনাম সরকারের দমন-পীড়ন আরও বেড়ে যাবে।
ধারণা করা হচ্ছে, এখন সেখানে সরকারের সমালোচনাকে আরও অসহিষ্ণু চোখে দেখা হবে এবং মৌলিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি এই সরকার অধিকতর বৈরী হয়ে উঠবে।
ভিয়েতনামের জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দমন-পীড়নের কুখ্যাতি আছে। এই বিভাগের প্রধান হিসেবে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে দায়িত্ব পালন করার সুবাদে লাম নিজেও নিষ্ঠুরতার দিক থেকে কম কুখ্যাত নন।
৬৬ বছর বয়সী লাম ১৯৭৯ সালে জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে মন্ত্রী পদে উন্নীত হন। তখন থেকেই তাঁর নজরদারিতে এজেন্সিটি ক্রমাগতভাবে ভিয়েতনামের নাগরিক সমাজের ওপর দমন-পীড়ন বাড়াতে থাকে।
সেই দমন-পীড়নের তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। লাম জননিরাপত্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিন পরই ভিয়েতনাম তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল।
একটি বিষাক্ত পদার্থ পানিতে ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়গুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভুক্তভোগীদের পক্ষে প্রতিবাদ করা কর্মীদের ভয় দেখানো, তাঁদের ওপর হামলা চালানো, তাঁদের গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করার জন্য একটি ভয়ংকর পুলিশি অভিযান চালানো হয়েছিল।
লাম মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র এক মাস পর; অর্থাৎ ২০১৬ সালের মে মাসে হ্যানয়ে ওই সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সফর করেছিলেন। ওই সময় অধিকারকর্মীরা ওবামার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু লামের অধীন নিরাপত্তা বাহিনী তাঁদের ওবামার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। এর দুই বছর পর ২০১৮ সালে লামের নিরাপত্তা বাহিনী সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত অত্যন্ত বিতর্কিত ও বাক্স্বাধীনতা খর্বকারী একটি আইনকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়। এই আইনের বিরোধিতাকারীদের ওপর নির্মম অত্যাচার করা হয়।
লামের নিরাপত্তা বাহিনী ভিয়েতনামের সীমানার বাইরেও দমন-পীড়ন চালিয়েছে।
যেমন ক্ষমতাসীন দলের সাবেক নেতা ত্রিন জুয়ান থানকে (যিনি পরে সরকারের সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন) ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বার্লিন থেকে এবং ত্রুং দুয়ে নাত নামের একজন ব্লগারকে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকক থেকে অপহরণ করে ভিয়েতনামে নিয়ে আসা হয়।
এই দুজনকেই দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে দু ভান তাই নামের আরেকজন ব্লগারকে ব্যাংকক থেকে অপহরণ করা হয়। তিনি এখনো ভিয়েতনামে বিচারপূর্ব আটকাবস্থায় রয়েছেন।
লামের অধীনে থাকা অবস্থায় ক্ষমতাধর নিরাপত্তা সংস্থা দেশটির নতুন মানবাধিকার আন্দোলনকে প্রায় নির্মূল করে ফেলেছে। ব্রাদারহুড ফর ডেমোক্রেসি, ভিয়েতনাম ন্যাশনাল সেলফ-ডিটারমিনেশন কোয়ালিশন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ভিয়েতনাম, লিবারেল পাবলিশিং হাউসসহ যে সংস্থাই দেশটিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রচারের চেষ্টা করেছিল, তাদের সবাইকেই কার্যত অকার্যকর করা হয়েছে।
সরকারের নীতির সমালোচনা করা প্রায় প্রত্যেক প্রভাবশালী মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্ট সাংবাদিককে লামের বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে নুগুয়েন ভু বিন নামের একজন সাবেক রাজনৈতিক বন্দী মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভিয়েতনামের গণতান্ত্রিক আন্দোলন একটি কঠিন ও অন্ধকার সময় পার করছে।’ এর এক সপ্তাহ পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
‘গণতন্ত্র’, ‘স্বশাসন’, ‘উদারতা’ শব্দগুলোকে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি সবচেয়ে বেশি ভয় পায় এবং এসব শব্দের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন যেকোনো গ্রুপকে পুলিশ নিশানা করে থাকে।
সরকারের নীতির সমালোচনা করা প্রায় প্রত্যেক প্রভাবশালী মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্ট সাংবাদিককে লামের বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে নুগুয়েন ভু বিন নামের একজন সাবেক রাজনৈতিক বন্দী মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভিয়েতনামের গণতান্ত্রিক আন্দোলন একটি কঠিন ও অন্ধকার সময় পার করছে।’ এর এক সপ্তাহ পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এখন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে লাম বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে ও কূটনৈতিক আলোচনায় অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিকে স্বাগত জানাবেন। লামের সঙ্গে করমর্দনের সময় কূটনীতিকদের ভুলে গেলে চলবে না, একটি ধ্বংসাত্মক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন এবং ভিয়েতনামের মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় ক্ষতি তিনি ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন।
● ইলেইন পিয়ারসন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার পরিচালক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ