ফি বছরই এই আফসোস শোনা যায় অধিকাংশ ঢাকাবাসীর মুখে—‘নাহ্! এবারও শীতটা জাঁকিয়ে পড়ল না!’ পৌষ–মাঘের অল্প কয়েক দিনই শীতবস্ত্র ‘প্রদর্শনের’ সুযোগ পান তাঁরা এবং শীত পড়ার ওই কয়েক দিনে তাঁদের শীতবস্ত্রের ‘কালেকশন’ আরও বেড়ে যায়। কেননা তাঁরা হুমড়ি খেয়ে নতুন নতুন ডিজাইনের বাহারি হাফ-ফুল জ্যাকেট, সোয়েটার ইত্যাদি কিনে ফেলেন। সুতরাং পরের বছর আরেকটু লম্বা সময় শীতের আশা করেন তাঁরা।
কিন্তু যাঁদের উদোম আকাশের নিচে শয্যা পাততে হয়, তাঁদের কাছে ‘শীত’ কেমন? ধারণা করা চলে, এসব মানুষ সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম কস্মিনকালেও শোনেননি, কিন্তু এই কবির কবিতার এই চরণে যেন তাঁদেরই মুখের কথা তুলে নিয়ে বসানো—‘হে সূর্য! শীতের সূর্য! হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায় আমরা থাকি।’
‘সকালের একটুকরো রোদ্দুর— একটুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামি’— ঠিক এভাবে হয়তো তাঁরা তাঁদের মনের কথা বলতে পারেন না, কিন্তু তাঁদের উপলব্ধির সারকথা অভিন্ন হওয়ারই কথা এবং সম্ভবত এ কথাও তাঁরা বলেন, ‘হে সূর্য, তুমি তো জানো, আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!’ তা ছাড়া আর কাকেই বা বলবেন এ কথা! তাঁদের কথা শোনার জন্য কার দায় পড়ে গেছে!
রাষ্ট্র–সমাজ এসব মানুষকে ‘ছিন্নমূল’ বলে ডাকে। ‘ভাসমান মানুষ’ বলেও শ্রেণিকরণ করা হয় তাঁদের। প্রশ্ন হলো, যাঁদের মূল কখনো মাটিই পায়নি, বরং ‘মূল’ ও ‘মূল্য’ কোনোটাই নেই যাঁদের, তাঁরা কি ‘প্রাণবিক মানুষের’ বাইরে কিছু?
দেশের গায়ে যখন উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ ট্যাগ লাগানো, তখনো এসব মানুষকে শীতের রাতে ফুটপাতে পাতা বিছানাতেই ‘ওম’ খুঁজতে হয়! অন্য কোথাও তাঁদের জন্য উষ্ণতার এতটুকু আয়োজন নেই! শয্যা মানে ছেঁড়া কাঁথা, চটের ছালা, প্লাস্টিক বা তেমন কিছু একটা বিছিয়ে, তেমন কোনো কিছু গায়ে মুড়িয়ে রাত পার করা। কবে কোন ‘মহান ব্যক্তি’র বিরতণ করা কম্বলটাও হয়তো টিকে আছে কারও কারও।
দেশের গায়ে যখন উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ ট্যাগ লাগানো, তখনো এসব মানুষকে শীতের রাতে ফুটপাতে পাতা বিছানাতেই ‘ওম’ খুঁজতে হয়! অন্য কোথাও তাঁদের জন্য উষ্ণতার এতটুকু আয়োজন নেই! শয্যা মানে ছেঁড়া কাঁথা, চটের ছালা, প্লাস্টিক বা তেমন কিছু একটা বিছিয়ে, তেমন কোনো কিছু গায়ে মুড়িয়ে রাত পার করা। কবে কোন ‘মহান ব্যক্তি’র বিরতণ করা কম্বলটাও হয়তো টিকে আছে কারও কারও।
পেশাগত কারণে যেহেতু মধ্যরাতে বাসায় ফেরা হয়, ফুটপাতে ফুটপাতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মোড়া ‘কুণ্ডলী’ পাকিয়ে থাকা এসব মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা বহুদিনের—সেই ‘উন্নয়নের জোয়ার’ শুরুর আগে থেকে। না বললেও বলা হয়ে যায় যে বর্ষায় ভেজা তাঁদের নিয়তি, যেভাবে গরমে ‘সেদ্ধ’ হওয়ায়ও। রাজধানীর এক কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের কারওয়ান বাজার অংশেই ফুটপাতে রাত কাটানো শিশু–নারী থেকে নানা বয়সী অন্তত ৫০ জনের দেখা মেলে। তবে বলতেই হয়, ফুটপাতগুলো এখন চকচকে টাইলসে মোড়ানো! অতএব বিছানাটা অন্তত এবড়োখেবড়ো হয় না, জীবন যতই খানাখন্দে ভরা হোক!
আবার মূল আছে, কিন্তু তা ‘পোক্ত’ নয়, এমন বহু মানুষকেও এই শীতের রাত বাইরে কাটাতে হয়। যেমন সিলেটের বালাগঞ্জের আবদুল গণি। রাজধানীর জিগাতলায় হাজি আফসার উদ্দিন লেনের নিরাপত্তারক্ষী তিনি। সারা রাত গলির মাথায় করা ফটকের পাশে প্লাস্টিকের এক চেয়ারে গুটিসুটি মেরে বসে থাকেন। কোনো ‘স্যার’ এলে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ান, সালাম দেন এবং ফটক খুলে দেন।
এ ছাড়া নির্দিষ্ট বিরতির পরপর প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা গলির এ মাথা থেকে ও মাথা বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে টহল দেন। পাকা ঘরে লেপ–কম্বলের উষ্ণতায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের আশ্বস্ত করেন, ‘আমি আছি, আপনারা আরামে ঘুমান।’ অথচ মানুষটির জীবনে না আছে ‘আরাম’, না আছে ‘ঘুম’।
ফুটপাতে বেঘারে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোর ‘শীতের অনুভূতি’ জানতে চাওয়া হয়নি কখনো। আবদুল গণির কাছে শোনার সুযোগ হলো তাঁর জীবনের ‘ষড়ঋতু’। আবদুল গণির ভাষ্যে, তাঁর জন্ম ১৯৬৫ সালে। কিন্তু রুগ্ন চেহারা আর পাকা চুল–দাড়ির মানুষটিকে দেখে যে কারও মনে হবে, বয়স নির্ঘাত আশির ঘরে! যৌবনের শুরু থেকেই নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করছেন। আগে নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় ছিলেন। আট বছর হলো ঢাকায়। ছয় সন্তান।
কৃষিজমি নেই এক ছটাকও। গ্রামের বাড়িটুকুই সম্বল। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলে এসএসসি পর্যন্ত পড়া শেষে গ্রাফিকসের কাজ শিখে এলাকাতেই জীবন চালানোর চেষ্টা করছেন। আর ঢাকায় আবদুল গণি দুই দফায় ‘ডিউটি’ করেন।
এলাকারই এক বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন তিনি। রাতে থাকেন গলির মুখের ফটকে। তবে রাতে ফটক থেকেই মাঝেমধ্যে ওই বাড়িতেও ঢুঁ দেন। ফলে দিন–রাতের প্রায় ২৪ ঘণ্টাই সতর্ক পাহারায় থাকতে হয় তাঁকে। দিন-রাতের শ্রমের বিনিময়ে তাঁর রোজগার ১৫ হাজার টাকা।
ঠিক একইভাবে জীবন টেনে নিতে আবদুল গণিকে প্রতিটা দিনই ‘সতর্ক’ থাকতে হয়। এই সতর্কতা আসলে হিসেবি থাকা, বছরের এক দিনও বেহিসেবি না হওয়ার সবক মনে রাখা। খাদ্য–খাওয়া, ওষুধবিষুদ, কাপড়চোপড়—সব খাতে পাই পাই হিসাব করা।
তবে এত হিসাবের পরও হাতে কিছু থাকে না। ব্যাংকে এক পয়সা জমা নেই। এক ইঞ্চি জমি করতে পারেননি। আবদুল গণি বলেন, কোনোমতে জীবনটা কেটে যাচ্ছে—ব্যস, এটুকুই। মাঝরাতে শীতে ঠকঠক করতে করতে তিনি যখন কথাগুলো বলছিলেন, কবি বুদ্ধদেব বসুর সেই চরণ মনে এল—‘বাইরে বরফের রাত্রি। ডাইনি-হাওয়ার কনকনে চাবুক গালের মাংস ছিঁড়ে নেয়।’
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]