শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে (২০০৯-২০২৪) প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই কোনো না কোনো মাত্রায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিল। তবে এর মধ্যে বিচার বিভাগের বিষয়টি ছিল সবচেয়ে ‘ন্যক্কারজনক’। কারণ, আদালতকে বলা হয় মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু গত সরকারের আমলে এই আদালত হয়ে উঠেছিল সরকারের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার। এর ফলে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল।
বিচার বিভাগের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব এবং একই সঙ্গে এটা তাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। কীভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যেতে পারে, তা নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন পরিসরে আলোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে আরও অনেক কিছুর পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। তবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে বিষয়টা নিয়ে কিছুটা ‘অস্পষ্টতা’ তৈরি হয়েছে।
গত ১৯ নভেম্বর সচিবালয়ে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: আইন মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়ত’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সংবাদ সম্মেলনে আইন মন্ত্রণালয়ের ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। সেখানে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা নিয়ে বিভিন্ন রকম মতামত রয়েছে। ওনাদের চিঠিতে বলা হয়েছে, মাসদার হোসেনের রায় কার্যকর করার জন্য পৃথক সচিবালয় দরকার। কিন্তু মাসদার হোসেন নিজে আমাকে বলেছেন, রায়ে পৃথক সচিবালয়ের কথা বলা নেই। এ নিয়ে উচ্চ আদালত, নিম্ন আদালত ও স্টেকহোল্ডারদের নানা মত রয়েছে। বড় পর্যায়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মিটিং করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’ (অতি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করেই দ্রুত নির্বাচন, সমকাল, ২০ নভেম্বর ২০২৪)
এর আগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নির্দেশনা অনুসারে গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের একটি প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ধারণাপত্রসহ ওই প্রস্তাবে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘ওই রায়ে ক্ষমতার পৃথক্করণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে একাধিকবার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রসঙ্গ এসেছে। আর বিচার বিভাগ পৃথক্করণের সর্বোত্তম কার্যকর উপায় স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। এ কারণে ওই মামলার রায়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বর্তমানে প্রচলিত দ্বৈত-শাসন কাঠামো তথা অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের যে যৌথ এখতিয়ার রয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাকে ক্ষমতার পৃথক্করণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।’ (বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব পাঠানো হলো আইন মন্ত্রণালয়ে, প্রথম আলো অনলাইন, ২৭ অক্টোবর ২০২৪)
মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের আবশিক্যতা নিয়ে প্রধান বিচারপতির প্রস্তাব এবং মাসদার হোসেনকে উদ্ধৃত করে দেওয়া আইন উপদেষ্টার বক্তব্যে কিছু ভিন্নতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আইন উপদেষ্টার বক্তব্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন নিয়ে এক ধরনের ‘দ্বিধা’ বা ‘অনিশ্চয়তা’ দেখা গেছে। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবে স্পষ্ট যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আলাদা সচিবালয় গঠন এখন অপরিহার্য।
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পরিবর্তন হলেও সরকার পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভাব এখনো পুরোদমে রয়ে গেছে। আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নানা কৌশলে বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টাও তাই লক্ষণীয়।
লক্ষণীয় হলো, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: আইন মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়ত’ নামে সংবাদ সম্মেলনটি যে দিন অনুষ্ঠিত হয়, সেই একই দিন অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর নিম্ন আদালতের বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন একটি আলোচনার আয়োজন করে। সেই আলোচনার পর দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ‘… বিচার বিভাগ পৃথক্করণ-সম্পর্কিত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় সরকারের প্রতি যে ১২ দফা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, তার ৮ম দফায় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করে বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়টিকে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এটি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইন ও বিধিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এই রায়ের ৭ম দফায় বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে সুপ্রীম কোর্টের প্রাধান্য নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। মাসদার হোসেন মামলার উল্লিখিত ৭ম ও ৮ম দফার নির্দেশনা মোতাবেক বিচার বিভাগের ওপর সুপ্রীম কোর্টের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হলে কিংবা আইন ও নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত করে বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।…’
নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতের বিচারকেরা বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়ের পক্ষে, সেটা স্পষ্ট। এর একাধিক যৌক্তিক কারণ এরই মধ্যে আলোচিত হয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না, বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের বাজেট বরাদ্দ এবং বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলিসহ আরও অনেক ক্ষেত্রেই আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারই তাদের মূল নিয়ন্ত্রক। নিয়ন্ত্রণের এই ক্ষমতা ব্যবহার করেই গত সরকার বিচার বিভাগকে নিজের ‘অনুগত’ করে রেখেছিল।
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পরিবর্তন হলেও সরকার পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভাব এখনো পুরোদমে রয়ে গেছে। আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নানা কৌশলে বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টাও তাই লক্ষণীয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এটা এখন বড় ধরনের অন্তরায়। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন করা ছাড়া তাই ভিন্ন কোনো উপায় নেই।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের নানা দাবি উঠেছে। সেসব দাবি বিবেচনায় নিয়ে সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও রয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য তারা একটি কার্যকর রূপরেখা তৈরি করবে।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক