অবিরাম বৃষ্টি আর প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার এ রকম চক্র আগে দেখা যায়নি। এই বৈরী আবহাওয়া ৩৪ বছর বয়সী খাদ্যপণ্যের উদ্যোক্তা সারাহ রুবেনকে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ভ্রমণে বাধা তৈরি করতে পারেনি। ঠাসাঠাসি করে পাত্রভর্তি বিশাল একটি ব্যাগ নিয়ে তিনি নিজ শহর কিলিনোচির বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি ভ্রাম্যমাণ ক্যাটারিং সার্ভিস পরিচালনা করেন সারাহ। জাফনা জেলায় অবস্থিত নিজ জন্ম শহরে একটি খাবারের দোকান রয়েছে তাঁর।
গত বছর সারাহ যখন তাঁর ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তখন মাথায় ভুলেও এ ভাবনা উঁকি দেয়নি যে কলম্বোর কোনো আয়োজনে তিনি বিনিয়োগ করতে পারবেন। এ বছর কলম্বোয় বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি জুসের দোকান দিয়েছেন।
সারাহ বলছিলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর উত্তর থেকে দক্ষিণের বাসভাড়া ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু মানুষ আবার উদ্যাপন শুরু করে দিয়েছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে।
আমরা সে জন্য সেখানে যেতে পারছি।’ তৈরি খাবার সরবরাহের পাশাপাশি সারাহ তাঁর দাদির কাছ থেকে ঐতিহ্যবাহী নারকেলের তেল তৈরি করাও শিখেছেন। জুসের সঙ্গে তাঁর ভ্রাম্যমাণ দোকানে সেই তেলও বিক্রি করছেন। সারাহ নিজেকে গ্রামের ক্ষুদ্র অর্থনীতি এবং বৃহত্তর অর্থে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অবদান রাখতে পারা একজন বলে মনে করেন।
সারাহ বলেন, ‘পরিস্থিতি মোটেই সহজ নয়, কিন্তু গত বছরের এ সময়ের তুলনায় আমি এখন ভালো আয় করছি। গত বছর এই সময়ে আমি শুধু একজন গৃহবধূই ছিলাম। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমি আমার দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অবশ্যই অবদান রাখব।’
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট থেকে একটি দেখার মতো বিষয় জন্ম হয়েছে। সুপারমার্কেটগুলোর তাক থেকে বিদেশি পণ্যগুলো ধারাবাহিকভাবে কমে গিয়ে সেখানে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো জায়গা করে নিয়েছে। এসব পণ্যের বেশির ভাগই তরুণ উদ্যোক্তারা তৈরি করছেন। স্থানীয় ও রপ্তানি বাজার—দুইয়ের জন্যই তাঁরা সেগুলো উৎপাদন করছেন।
এই তো গত বছর দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো অভূতপূর্ব এক জনবিক্ষোভে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সেই ঘটনায় তখনকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত শূন্য হয়ে গিয়েছিল। তীব্র জ্বালানির সংকট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ না থাকা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সহযোগিতা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। শ্যাম্পু, কাঁচি, পেপার ন্যাপকিনসহ অনেক পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
গত জুলাই মাসে পার্লামেন্টে ভোটে রনিল বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় তিনি আট মাস পার করেছেন। এ সময় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংস্কারে আইএমএফের বহুল প্রত্যাশিত ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা পাওয়া গেছে। নতুন প্রেসিডেন্ট শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়াত্ব দশা থেকে উত্তরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যাহোক, কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, অর্থনৈতিক সংকট শ্রীলঙ্কার জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগও হতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অথবা স্বার্থ, যেটাই থাকুক না কেন, সাধারণ নাগরিকের সংকল্প এ ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠতে পারে। সারাহ বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা করতেই হবে। আমি দেখছি, আমার গ্রামের মানুষেরা, যত ছোটখাটো হোক না কেন, কত ধরনের ব্যবসা করার চেষ্টা করছে।’
শ্রীলঙ্কায় এখনো জ্বালানির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু আগের মতোই সেই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কাউকে জ্বালানির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। প্রযুক্তিনির্ভর একটি কোটাব্যবস্থা চালু হওয়ায় জনভোগান্তি কমে এসেছে। গণপরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে জ্বালানির ঘাটতি এখন আর প্রভাব ফেলছে না। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট থেকে একটি দেখার মতো বিষয় জন্ম হয়েছে। সুপারমার্কেটগুলোর তাক থেকে বিদেশি পণ্যগুলো ধারাবাহিকভাবে কমে গিয়ে সেখানে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো জায়গা করে নিয়েছে। এসব পণ্যের বেশির ভাগই তরুণ উদ্যোক্তারা তৈরি করছেন। স্থানীয় ও রপ্তানি বাজার—দুইয়ের জন্যই তাঁরা সেগুলো উৎপাদন করছেন।
২৮ বছর বয়সী তরুণ উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারক সাহান বাকমিবেবা। গত তিন বছরে কোভিড মহামারি এবং সামাজিক রাজনৈতিক অসন্তোষের মধ্যে তিনি ঐতিহ্যবাহী ঔষধি ও মসলাজাতীয় পণ্যের ব্যবসা বড় করেছেন।
প্রাচীনকাল থেকে দ্বীপদেশটির যেসব মসলা ও ওষুধ রোগ নিরাময়ের জন্য মানুষ ব্যবহার করে আসছে, সেগুলো দিয়েই গড়ে তুলেছেন তাঁর প্রতিষ্ঠান। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তাঁর ব্র্যান্ড ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে তাঁর ব্যবসার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ পরিবারের সেসব মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে, যাঁরা কৃষি অর্থনীতির অংশ।
দক্ষিণাঞ্চলের সাহান ও উত্তরাঞ্চলের সারাহ দুজনের ব্যবসার ধরন ও বিনিয়োগে ফারাক থাকলেও তাঁরা দুজনেই শ্রীলঙ্কার একই আর্থসামাজিক বাস্তবতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন।
শ্রীলঙ্কায় তরুণ উদ্যোক্তাদের এ নবজন্ম দেশটির অর্থনীতিকে বাঁচাতে পারবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল ১২ দিনের সফর শেষে গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়ার সময় একটি বিবৃতি দিয়েছে। আইএমএফ বলছে, শ্রীলঙ্কার সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ‘সম্ভাব্য উন্নতির’ পথে রয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক নীতি-সম্পর্কিত পরিবেশ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।
ফ্রান্সেস বুলাথসিংহলা শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক ও দেশটির সমকালীন রাজনীতি বিষয়ে লেখক
কলম্বো থেকে পাঠানো, ইংরেজি থেকে অনূদিত