মাহমুদুর রহমান মান্নার সাক্ষাৎকার

মানুষ যদি রাস্তায় বিক্ষোভ করে, তার মধ্যে তো আওয়ামী লীগ ঢুকে পড়বেই

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী রাজনীতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগ ও সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রথম আলো:

জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির সামনে নতুন কী সম্ভাবনা তৈরি করল?

মাহমুদুর রহমান মান্না: এই গণ-অভ্যুত্থান একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তার কারণে বাংলাদেশের সমাজে নতুন অনেক আশা জেগেছে। যাঁরা আন্দোলনটা করেছেন, তাঁরা স্পষ্টতই বলেছেন, তাঁরা একটা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চান। বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও তাঁদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সারা দেশের মানুষ একটা জীবনদানের বিদ্রোহের মতো একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এর ফলে মানুষের মধ্যে চেতনা এসেছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার দেখে তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন, তাঁরা যে পরিবর্তনের আশা করছেন, তার একটা সূচনা সম্ভবত হয়েছে।

প্রথম আলো:

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় আড়াই মাস হতে চলল। সামগ্রিকভাবে সরকারের কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

মাহমুদুর রহমান মান্না: প্রথমত, এত কম সময় পরিসরের সরকারের কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করাটা যুক্তিসংগত হবে না। দ্বিতীয়ত, যে জটিল পরিস্থিতিতে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আমার বিবেচনায় পুরো আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সেটা খুব সংগঠিতও ছিল না। সাধারণভাবে দেশ বদলানোর একটা লক্ষ্য থাকলেও এটাকে লক্ষ্যাভিমুখী আন্দোলন বলা যাবে না। এ কারণে এই আড়াই মাসে সরকারকে যেসব জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, সেটা হয়তো তাদের নিজেদের ভাবনায় ছিল না। 

প্রথম আলো:

সংবিধানসহ বেশ কয়েকটি জায়গা সংস্কারের জন্য কমিশন হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোই তো সংস্কারের প্রধান অংশীজন। সংস্কার প্রশ্নে আপনাদের বর্তমান অবস্থান কী?

মাহমুদুর রহমান মান্না: সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের একটা সম্মিলিত অবস্থান ছিল। আমরা ৪১ থেকে ৪২টি দল বিগত সরকারের আমলে যে যুগপৎ আন্দোলন করছিলাম, সেখানে ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে আমাদের সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী নয়। কিন্তু দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের সংস্কারভাবনাগুলো আপডেট করে যেভাবে বলতে হয়, সেটা বলার চেষ্টা করছি। আগে মনে হয়েছিল, সংস্কারের সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু এখন কিছু কিছু ক্ষেত্র, যেমন সংখ্যানুপাতিক ভোটসহ কিছু বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য সামনে আসছে। এখন আমাদের কারও কারও কাছে মনে হচ্ছে, সংখ্যানুপাতিক ভোট এ মুহূর্তে বা দু–একটা মেয়াদে করা যাবে না।

প্রথম আলো:

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে সংস্কার কতটা কাজে আসবে?

মাহমুদুর রহমান মান্না: যে পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, তার মূল শক্তি রাজনৈতিক দল। কিন্তু আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলছি, আমাদের এখানে রাজনীতিতে যারা ম্যাটার করে, সেই দলগুলোর মধ্যে এই বোধ দেখা যাচ্ছে না। এই অভ্যুত্থান সমাজের মধ্যে গুণগত পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা জন্ম দিয়েছে, সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দায়িত্বশীল দলগুলোকে দায়িত্ববান বলে মনে হচ্ছে না।

প্রথম আলো:

ইতিহাসের কিছু বিষয় নিয়ে দু-একজনের বক্তব্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এটা এ মুহূর্তে তোলা কি জরুরি ছিল?

মাহমুদুর রহমান মান্না: এ মুহূর্তে এসব প্রসঙ্গ তোলা একেবারেই দরকার নেই। ভবিষ্যতে যে কতখানি দরকার আছে, সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। অনেক জিনিস আছে না, কাজের স্রোতে মিলিয়ে যায়, বিতর্কও মরে যায়, বিতর্কের আর প্রয়োজনও হয় না।

প্রথম আলো:

আওয়ামী লীগকে রাজনীতি ও ভোট থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে আরেকটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ বিষয়কে কীভাবে দেখছেন?

মাহমুদুর রহমান মান্না: এটা খুব বড় একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশের সমাজে যত বিতর্ক আছে, সেটা ভারতেও নেই। ফলে বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেটাকে নিষ্পত্তি করেই এগোতে হবে। ইউনূস সাহেব অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। আমার কাছে মনে হয়, এর একটা ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের কথা বলেছেন। সেটা করতে পারলে খুবই ভালো। তার জন্য অনেক সক্ষমতা থাকা দরকার এবং অনেক বেশি সজাগ থাকা দরকার। কিন্তু সরকারকে তেমন দেখছি না। জিনিসের দাম বাড়বে হু হু করে, রাস্তায় মানুষ যানযটে নাকাল হবে, আর এদিক দিয়ে যদি সবাইকে রাজনীতি করার স্বাধীনতা দিয়ে দেন, তাহলে সবটা লেজেগোবরে হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ তো আর ভুঁইফোড় সংগঠন নয়। মানুষ যদি জিনিসপত্রের দাম নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করে, তার মধ্যে তো আওয়ামী লীগ ঢুকে পড়বেই। সুতরাং এ বিষয়কে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে খুব স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত।

প্রথম আলো:

সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

মাহমুদুর রহমান মান্না: অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে সবার সমর্থন পেয়েছে, সেটা আমাদের দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। এত রক্তদানের পর সরকার বিশেষ একটা অনন্য অবস্থানে রয়েছে, সেখান থেকে তাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীসহ অংশীজনদের সঙ্গে সরকারের মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে হবে।