নানা কারণে সমস্যা জর্জরিত মানুষ আইনি প্রতিকারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হন। ধনী–গরিব নির্বিশেষে যে কারও অধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে। বিচার পেতে আইনে নির্ধারিত কোর্ট ফি ছাড়াও মামলা দায়ের থেকে শুরু করে নিষ্পত্তি পর্যন্ত বেশ পয়সাপাতি খরচ হয়। এর মধ্যে রয়েছে আইনজীবীর ফি পরিশোধ, ওকালতনামা ক্রয়, রায় ও আদেশের অনুলিপি সংগ্রহ, হাল আমলে ডিএনএ টেস্টের খরচ ইত্যাদি। এর মধ্যে খরচ বেশি হয় আইনজীবীর ফি পরিশোধে। যত বড় আইনজীবী, তাঁর তত বেশি ফি।
গরিব মানুষ এসব পয়সাপাতি খরচের ভয়ে অধিকার বঞ্চিত হয়েও আদালতের দ্বারস্থ হতে ভয় পান। একসময় বিচার পেতে সাত ঘাটে টাকা খরচের ভয়ে আদালতে না এসে তাঁরা মুখ বুজে সব সহ্য করতেন। এ কারণে বিত্তবানদের প্রতিপক্ষ হয়ে দরিদ্র অসহায় মানুষের পক্ষে আইনি লড়াই চালানোটা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলেও অর্থবিত্ত খরচের সামর্থ্য না থাকায় আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেকে।
আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যই ছিল এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত থাকবে। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৯ (১) অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে মর্মে উল্লেখ আছে। ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩৩(১) অনুচ্ছেদে গ্রেপ্তার ও আটক ব্যক্তিকে তাঁর মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগের বিধান রাখা হয়েছে।
এমন অনেক চমৎকার বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের সংবিধান অন্যতম সুন্দর সংবিধান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এ ছাড়া ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৭-এ কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়া আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকারের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আর্থিক সংগতি না থাকায় দরিদ্র মানুষেরা সাংবিধানিক এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন অনেক দিন।
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত মূলনীতি তথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা ও বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাষ্ট্রের সম্পদ ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নাগরিকেরা এসব সুবিধা ভোগ করে থাকেন। আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ। স্বাধীনতার পর শত ঘাত–প্রতিঘাত ও চড়াই–উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কল্যাণরাষ্ট্রের কাতারে এগোবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অনেক নীতির মধ্যে ‘সুযোগের সমতা নীতি’ বাস্তবায়ন করতে হবে।
আর্থিক সংকটের কারণে যাতে নাগরিকেরা আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে সমতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, এ জন্য রাষ্ট্র আইনি সহায়তা প্রদান আইন–২০০০ প্রণয়ন করে। এটা গরিব মানুষের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনজীবীর ফি পরিশোধের মাধ্যমে ধনী–দরিদ্রের মধ্যে আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে একটা সমতা নিয়ে আসে। সহজ করে বলতে গেলে মামলা দরিদ্র মানুষের আর আইনজীবির ফি পরিশোধ করে সরকার।
বিচারপ্রার্থী মানুষকে দ্রুততম সময়ে কম খরচে ন্যায়বিচার প্রদান করা আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হলেও বিপুলসংখ্যক মামলার বিপরীতে বিচারক স্বল্পতা এবং পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতাসহ নানান সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ ক্ষেত্রে আইনি সহায়তার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ও কম খরচে অনেক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এই সরকারি ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ ও কার্যকর হিসেবে ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। সরকারি খরচে আইনি সহায়তার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে হাসি ফুটেছে অনেকের মুখে।
শুরুতে দরিদ্র মানুষের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনজীবির ফি পরিশোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন আইনি সহায়তা প্রদানের ধরন ও প্রকার বহুমাত্রায় বিস্তৃত হয়েছে। আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার একজন বিচারককে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এখন সরকারি খরচে মামলা পরিচালনা ছাড়াও যেকোনো আইনি সমস্যায় পরামর্শ গ্রহণের জন্য জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে যে কেউ নির্দ্বিধায় আসতে পারেন।
সর্বশেষ নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত আয়কর সীমার নিম্নে বসবাসকারী যেকোনো ব্যক্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধা বা যেকোনো শ্রমিক আইনি সহায়তা পাবেন। এ ছাড়া কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন কোন ব্যক্তি, বয়স্ক ভাতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মা, পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশু, দুর্বৃত্ত দ্বারা অ্যাসিডদগ্ধ নারী ও শিশু, আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তি, অসচ্ছল বিধবা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সব ধরনের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় আইনি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি আদালত অঙ্গনে রয়েছে আইনি সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে অধস্তন আদালত পর্যন্ত এই কার্যক্রম বিস্তৃত। এককথায় যেখানে আদালত, সেখানেই রয়েছে আইনি সহায়তা। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত রয়েছে আইনি সহায়তা প্রদান কমিটি রয়েছে। দেশের কোনো নাগরিক যেন আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত না হন, সে জন্য সরকার বিষয়টির ব্যাপক প্রচার ও তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য প্রতিবছর ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনি সহায়তা দিবস পালন করে আসছে।
প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশের কাছে আগে উচ্চ আদালতে গিয়ে বিচার পাওয়ার বিষয়টি ছিল কষ্টকর। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে আইনি সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় দেওয়ানি আপিল, দেওয়ানি রিভিশন, ফৌজদারি আপিল, ফৌজদারি রিভিশন, লিভ টু আপিল, জেল আপিল, রিট পিটিশনসহ মামলার গুণাগুণ বা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আইনি মতামত দেওয়া হয়।
আইনি সহায়তা প্রদান কার্যক্রমে উচ্চ আদালত এবং অধস্তন আদালতে রয়েছেন তালিকাভুক্ত প্যানেল আইনজীবী । তাঁরা এসব দরিদ্র মানুষের মামলা পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট হারে ফি পেয়ে থাকেন। মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ফির হার যা–ই হোক না কেন, আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনেক বড় বড় আইনজীবীকেও দরিদ্র মানুষের কথা বিবেচনা করে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব মামলা পরিচালনায় উৎসাহী দেখেছি।
আর্থিক সামর্থ্য নির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তি সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে বিনা মূল্যে আইনি তথ্যসেবা গ্রহণ, আইনি পরামর্শ গ্রহণ এবং বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির সেবা গ্রহণ করতে পারেন। আমি নাটোরের জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অনেকে মামলা দায়েরের আগে মামলায় জয়পরাজয়, লাভক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করেছেন।
এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা মামলা পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সেসব বিষয়ে আইনি পরামর্শ নিয়েই অনেকে সন্তুষ্ট থেকেছেন। তা ছাড়া মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে কী করণীয়, আইনি জটিলতায় পড়ার আগে করণীয় ও বর্জনীয় ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কেও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে আইনি সহায়তা নেওয়া যায়।
অনেকে আছেন যাঁদের প্রকৃত অধিকারের ন্যায্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু আইনি জটিলতা, সম্মানহানি ও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয়ে প্রতিপক্ষকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজের অধিকার ছেড়ে দেন। এমন মানুষের জন্য আদালতের কাঠগড়া নয়; বরং জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে আপস মধ্যস্থতায় বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে।
এতে একদিকে যেমন রক্ষা হয় সামাজিক সম্মান, তেমনি কোনো প্রকার হয়রানি ও ঝামেলা ছাড়াই বিরোধের স্থায়ী নিষ্পত্তি ঘটে। বিচারকাজে আন্তরিক হলে মেডিয়েশনের মাধ্যমে আপসে অনেক পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়। আমি ২০২১ সালে পঞ্চগড়ে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এরকম কিছু বিরোধের নিষ্পত্তি করেছি।
বাংলাদেশে অধস্তন আদালত এবং উচ্চ আদালত মিলে ৪০ লাখের মতো মামলা বিচারাধীন। প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে এসব মামলা–মোকদ্দমায় আদালতের বারান্দায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে মামলাজট একটি বড় অন্তরায়। রায়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পরেও উভয় পক্ষের মধ্যে সমস্যাগুলো জিইয়ে থাকে যুগের পর যুগ। ফলে দাদার আমলে নিষ্পত্তিকৃত বিষয়টি বংশানুক্রমে নাতিদের পর্যন্ত গড়ায়।
বিচারপ্রার্থী মানুষকে দ্রুততম সময়ে কম খরচে ন্যায়বিচার প্রদান করা আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হলেও বিপুলসংখ্যক মামলার বিপরীতে বিচারক স্বল্পতা এবং পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতাসহ নানান সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ ক্ষেত্রে আইনি সহায়তার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ও কম খরচে অনেক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এই সরকারি ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ ও কার্যকর হিসেবে ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। সরকারি খরচে আইনি সহায়তার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে হাসি ফুটেছে অনেকের মুখে।
মো. মতিউর রহমান বিচারক (যুগ্ম জেলা জজ), ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, নীলফামারী।