কমলার জনপ্রিয়তার পারদ চড়ছে, কিন্তু টিকে থাকবে কতক্ষণ?

কমলা হ্যারিস

রাজনীতিতে একটি সপ্তাহকে সব সময়ই দীর্ঘ সময় বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে চলতি সপ্তাহটি কমলা হ্যারিসের জীবনের সম্ভবত দীর্ঘতম সপ্তাহ। কাগজে–কলমে যদিও জো বাইডেন এখনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট, তবে রাজনীতিতে তিনি যে ইতিমধ্যেই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছেন, তা তিনি নিজেও টের পাচ্ছেন। কারণ, সবার দৃষ্টি এখন কমলার দিকে।

কমলা যে গতিতে আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম অজনপ্রিয় একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে ডেমোক্র্যাট পার্টির সম্ভাব্য শীর্ষ নেতার আসনে বসেছেন এবং তাঁর পেছনে উৎসাহী ভক্তদের যে বিশাল বাহিনী দেখা যাচ্ছে, তা এককথায় বিস্ময়কর। বাইডেনের এই রাজনৈতিক পতনকে ব্যাপকভাবে শেক্‌সপিয়ারিয়ান ট্র্যাজেডির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে হ্যারিসের ভাগ্যের আচমকা উত্থান রূপকথার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সপ্তাহের ঘটনা সারসংক্ষেপের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব, বাইডেন নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে দাড়িয়েছেন এবং গত রোববার তিনি কমলাকে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিয়েছেন। তার পরের দিন সোমবার ডেমোক্রেটিক শিবির সর্বশক্তি দিয়ে কমলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লাখো চাঁদাদাতা তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। কমলার প্রচারণা শুরুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ডেমোক্র্যাট শিবিরের চাঁদা তহবিলে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার জমা পড়েছে।

দলের হয়ে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে লড়তে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য মঙ্গলবার নাগাদ কমলা দলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন পেয়েছেন। এরপর শুক্রবার বারাক ওবামা ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলাকে সমর্থন দেন। এই সব দিক বিবেচনায় দলের প্রার্থী হিসেবে তাঁর অভিষেক-পর্ব বলা যায় প্রায় শেষ।

আরও পড়ুন

গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কমলা শুধু তাঁর দলের অভিজাত শ্রেণির একচেটিয়া সমর্থন পাননি; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশও তাঁকে উৎসাহ দিচ্ছে। এই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় ব্রিটিশ পপস্টার শার্লি এক্সসিএক্স গত রোববার তাঁর এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ‘কমলা ইজ ব্র্যাট’ (কমলা এক দস্যি মেয়ে) লিখে পোস্ট করেছেন। শার্লির এই অনুমোদন কমলাকে পপ কালচারের মাঝখানে নিয়ে এসেছে। শার্লির নতুন অ্যালবাম ব্র্যাট তুমুল আলোড়ন তুলেছে। অ্যালবামটির কলাপাতা-সবুজ রং সব জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। শার্লির অনুমোদনসূচক টুইটের পরপরই কমলা হ্যারিসের এক হ্যান্ডলের ব্যাকড্রপের রং শার্লির ব্র্যাট অ্যালবামে ব্যবহৃত কলাপাতা সবুজ রঙে পরিবর্তিত করা হয়েছে।

কমলার প্রচারণা কেবল ব্র্যাটভক্তদেরই আলিঙ্গন করেনি, এটি সব কমলা–সমর্থকের দিকে ঝুঁকছে। তাঁকে নিয়ে বানানো নানা ধরনের মিম ইন্টারনেটে প্লাবিত হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে হিস্প্যানিক তরুণদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি তাঁর প্রয়াত মায়ের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মা আমাদের বলেছিলেন, “বাছারা, তোমাদের কী সমস্যা বলো তো? তোমরা কি ভাবো যে তোমরা একদিন ঠাস করে নারকেলগাছ থেকে পড়েছ?”’ তিনি এই কথার মধ্য দিয়ে তরুণদের বোঝাতে চাইছিলেন, একদিনে হুট করে কেউ বড় হয় না। এরপর কমলা তরুণদের দার্শনিক জ্ঞান দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা যেখানে বেড়ে উঠছ এবং তোমরা যেখান থেকে উঠে এসেছ, তার পুরো পটভূমিতে তোমার অস্তিত্ব আছে।’

এখন পর্যন্ত কমলা গাজা ইস্যুতে অতি সাবধানে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছেন। তিনি তাঁর থেকে প্রগতিশীলদের বিচ্ছিন্ন না করার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি তিনি নিজেকে ‘ইসরায়েলবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত না করারও চেষ্টা করছেন। গত বুধবার কংগ্রেসে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভাষণ তিনি সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যান এবং এর বদলে তিনি তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে একান্ত বৈঠক করেছেন।

ওই বক্তৃতার পরপরই নারকেলগাছের ছবির মধ্যে কমলার ছবি বসিয়ে দিয়ে বানানো মিম ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছিল। কমলার হুট করে প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা পেয়ে যাওয়ার বিষয়টি নেটিজেনদের ‘ঠাস করে নারকেলগাছ থেকে পড়ার’ কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ফলে সেই মিমগুলো চলতি সপ্তাহে ফের ইন্টারনেটে প্লাবিত হয়েছে। তবে সেগুলোতে তাঁর ইতিবাচক দিকই ফুটে উঠছে।

ইন্টারনেট এখন কমলার অনন্য কথা বলা ও হাঁটাচলার স্টাইলকে একটি সম্পদে পরিণত করছে। টিকটকের কনটেন্ট এবং নারকেলবিষয়ক মিমগুলো এখন পর্যন্ত একটি অত্যন্ত হতাশাজনক নির্বাচনী শিবিরে অতি প্রয়োজনীয় আনন্দ ও উচ্ছ্বাস যুক্ত করতে সাহায্য করেছে। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে কমলা এখন দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছেন। একটি নতুন জেনারেশন ল্যাব জরিপে দেখা গেছে, কমলা ভোটারদের একটি বিরাট অংশের সমর্থন পেয়েছেন। অন্য একটি জরিপে দেখা গেছে, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বকে উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত করেছেন।

প্রশ্ন হলো, কমলা হ্যারিসের এই যে জনপ্রিয়তার ঢল দেখা যাচ্ছে, তা কি শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যাবে?

মার্কিন নির্বাচনে অবশ্যই এমন নজির আছে, যেখানে একজন নারী দ্রুত প্রায় শিখর পর্যন্ত ওঠার পর দ্রুতই তাঁকে ছিটকে ফেলে দেওয়া হয়। রিপাবলিকানরা ইতিমধ্যে কমলাকে বর্ণবাদী এবং শ্লীলতাবর্জিত আক্রমণের মাধ্যমে ছিটকে ফেলে দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তারা ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর রেকর্ডকেও আক্রমণ করেছে। তারা তাঁকে ‘সীমান্ত জার’ বলে আখ্যায়িত করে অভিবাসন–সংকটের জন্য দায়ী করেছে।

এরপর আছে গাজার মানবিক সংকট। ইন্টারনেট হ্যারিসকে এখন একটি প্রেমময় ও লাস্যময়ী মুখ হিসেবে তরুণদের সামনে তুলে ধরছে বটে; তবে তার সেই ভাবমূর্তি তিনি কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবেন, সেটি এক প্রশ্ন। গাজা প্রশ্নে বাইডেন যে ভয়ংকর নীতি (যা তরুণদের কাছে গভীরভাবে অজনপ্রিয়) অনুসরণ করে আসছেন, কমলা যদি সেই নীতির মুখ হয়ে ওঠেন, তাহলে তিনি ডেমোক্র্যাটদের অনেকের সমর্থন হারাবেন। যেমন মিশিগান অঙ্গরাজ্যের কথা বলা যেতে পারে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেট। এখানে প্রচুর আরব আমেরিকান নাগরিক রয়েছেন। গাজা ইস্যুতে কমলার ভাবমূর্তি বাইডেনের মতো হলে এই ধরনের অঙ্গরাজ্যে কমলা দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাবেন।

আরও পড়ুন

এখন পর্যন্ত কমলা গাজা ইস্যুতে অতি সাবধানে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছেন। তিনি তাঁর থেকে প্রগতিশীলদের বিচ্ছিন্ন না করার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি তিনি নিজেকে ‘ইসরায়েলবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত না করারও চেষ্টা করছেন। গত বুধবার কংগ্রেসে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভাষণ তিনি সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যান এবং এর বদলে তিনি তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে একান্ত বৈঠক করেছেন।

গত বৃহস্পতিবার কমলা বলেছেন, গাজা ইস্যুতে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করার সময় এসেছে। তবে একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলের জন্য ‘অটল’ সমর্থনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। এখন কমলা আর ট্রাম্প দুটি পরস্পরবিরোধী মুখ। কমলা ‘প্রসিকিউটর’, ট্রাম্প ‘অপরাধী’। ট্রাম্প একজন বৃদ্ধ মানুষ, কমলা একজন অপেক্ষাকৃত তরুণী।

আবার বলছি, এক সপ্তাহ রাজনীতিতে দীর্ঘ সময়। আর নির্বাচন হতে এখনো ১৪টি সপ্তাহ বাকি।

  • আরওয়া মাহদাবি গার্ডিয়ান–এর কলামিস্ট

  • দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ