মুদ্রানীতি কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে

কোটা সংস্কারের আন্দোলন ঘিরে দেশের ভেতর ভয়াবহ ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি বিবৃতি প্রকাশ করে। মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতি বা ঋণনীতিতে দুটি প্রধান পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথমটি হলো নীতি সুদহার (রেপো হার) সাড়ে ৮ শতাংশে ধরে অপরিবর্তিত রাখা এবং তা অন্তত ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাশাপাশি আরও যে দুটি সহায়ক নীতি হার আছে, এসডিএফ হার ও এসএলএফ হার—সে দুটিও যথাক্রমে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা। রেপোর হার হলো বাংলাদেশ ব্যাংক আপত্কালীন বা তারল্যসংকটের সময় ব্যাংকগুলোকে যে সুদহারে ঋণ দিয়ে থাকে। এটি বাড়লে ব্যাংকগুলোর জন্যও ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়ে, কমলে কম। এটির গতি–প্রকৃতি অনুসারে তাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় তাদের সুদহার বাড়ায় বা কমায়।

গত অর্থবছরে এই হার ৬ শতাংশ থেকে কয়েক ধাপে বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয় বাজারে ঋণের পরিমাণ তথা টাকার সরবরাহ সীমিত করে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে। ঘোষিত মুদ্রানীতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেবে না, অন্তত ডিসেম্বর পর্যন্ত। কেননা টাকা ছাপিয়ে বা সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দিলে তা মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেয় বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে। এখন প্রশ্ন হতে পারে যে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঘোষিত নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থান কতটা ধরে রাখতে পারবে? উত্তরটা হলো এই নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি থেকে সরে আসার জন্য দ্রুতই চাপের মুখে পড়তে হবে। আর তা হবে হঠাৎ ওলট-পালট হয়ে যাওয়া দেশের ভেতরের পরিস্থিতির জন্য।

সুদের হার কমানো ও টাকা ছাপানোর পথে হাঁটা মানে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার লাগামে ঢিল দেওয়া। তার মানে ঘোষিত মুদ্রানীতি থেকে কিছুটা পিছিয়ে আসা। দেশের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়তোবা বাংলাদেশ ব্যাংককে তা–ই করতে হবে

মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রাক্কালে এ রকম মারাত্মক কিছু হতে পারে, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি সংগত কারণেই। বরং মূল্যস্ফীতি অল্প দিনের মধ্যেই প্রশমিত হতে থাকবে, সেই প্রত্যাশা বা পূর্বানুমান নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি তৈরি করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখতে চাওয়ার মধ্যে এর প্রতিফলনও ঘটেছে। কিন্তু সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়াসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম ইতিমধ্যে আরও চড়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে দাম কিছুটা কমবে বটে, তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি তেমন প্রশমিত হবে না। তার মানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ আরেক দফা কমানোর চাপ তৈরি হতে পারে। কেননা মানুষের হাতে ইতিমধ্যে নগদ টাকা বেড়ে গেছে।

অস্থির-অনিশ্চিত সময়ে মানুষ বেশি করে নগদ টাকাই হাতে রাখতে চায়। এর প্রমাণ মিলেছে কারফিউ শিথিল করে সীমিত সময়ের জন্য ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলার প্রথম দিনই (২৪ জুলাই) ব্যাংকগুলোতে টাকা তোলার প্রচণ্ড চাপ তৈরি হওয়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংক দুই দিনে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংককে। বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ব্যাংকের বাইরে থাকলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে আনা কঠিনতর হয়। এই টাকার কিছু অংশ ব্যাংকে ফেরাতে হলে সুদের হার বাড়ানো ছাড়া তেমন কোনো হাতিয়ার নেই।

অন্যদিকে সম্পদ-সম্পত্তির ধ্বংসসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেছে, তা কাটিয়ে উঠতে গেলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং ব্যবসার ব্যয় কমানোর জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ানো মানে ব্যাংক থেকে ঋণের জোগান বাড়ানো—সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের জন্যই। চড়া সুদে ঋণ নেওয়াটা বেসরকারি খাতের, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যয়বহুল হবে। স্বাভাবিকভাবেই সুদের হার কমানোর চাপ তৈরি হবে। পাশাপাশি ঘাটতি অর্থায়নসহ সরকারি বিনিয়োগকে সমর্থন দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হয়তো টাকা ছাপানোর দিকেই যেতে হবে।

সুদের হার কমানো ও টাকা ছাপানোর পথে হাঁটা মানে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার লাগামে ঢিল দেওয়া। তার মানে ঘোষিত মুদ্রানীতি থেকে কিছুটা পিছিয়ে আসা। দেশের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়তোবা বাংলাদেশ ব্যাংককে তা–ই করতে হবে। তাতে মূল্যস্ফীতিতে দিশাহারা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ অবস্থায় রাজস্বনীতির মাধ্যমে কিছু স্বস্তি আনা যেতে পারে কি না, তা বিশ্লেষণসাপেক্ষ।

● আসজাদুল কিবরিয়া লেখক

[email protected]