জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে দারিদ্র্যের সুনিবিড় সংযোগ রয়েছে। কখনো কখনো এ সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে সরাসরিভাবে দারিদ্র্যের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়।
আবার কখনো কখনো জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব অপ্রত্যক্ষ পথ ধরে আসে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন বন্যার প্রকোপ বাড়িয়ে দিয়ে ঘরবাড়ির ক্ষতি করে, যাতে মানুষের বঞ্চনা বেড়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মোটামুটি চারটি প্রাকৃতিক বা পরিবেশগত বিষয় প্রভাবিত হয়—ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ, খরার ব্যাপ্তি, বন্যার বিস্তৃতি ও ভূমির লবণাক্ততা।
এর সব কটিই দারিদ্র্যের ওপরে প্রভাব ফেলে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন-উদ্ভূত ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে শস্যের হানি হয়।
খরা ও জমির লবণাক্ততার ফলে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়ে ফসলের উৎপাদন কমে যায়।
বন্যার ফলে কৃষিজমি পানির নিচে থাকায় জমির ওপরের সবচেয়ে উর্বর মাটি ধুয়ে যায়। লবণাক্ততাও জমির উর্বরতা কমিয়ে দেয়।
দুটিই ভবিষ্যৎ ফসল উৎপাদনকে ব্যাহত করে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা মানুষের ঘরবাড়ি, শস্যের গোলা ও গবাদিপশুর ক্ষতি করে। এর কারণে জনগণের সাধারণ ও উৎপাদনশীল সম্পদ বিনষ্ট হয়।
বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে আসে এবং কর্ম নিয়োজনের সুযোগ কমে যায়।
যাতায়াতব্যবস্থা নষ্ট হলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তেমনি স্কুলে কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাতায়াত বিঘ্নিত হয়ে পড়াশোনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নানা রকমের নতুন নতুন রোগের উদ্ভব হয় এবং বিবিধ স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন দারিদ্র্যকে আরও দুটি দিক থেকে প্রভাবিত করে।
প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যাঁরা আগে থেকেই পরিবেশ-নাজুক ভূমিতে বসবাস করছিলেন—যেমন চর, হাওর কিংবা সমুদ্র-উপকূলভূমিতে, তাঁরা অধিক সংখ্যায় পরিবেশ-দারিদ্র্যের শিকার হন।
দ্বিতীয়ত, দরিদ্র জনগোষ্ঠী জীবিকা, জীবনযাপন, চিকিৎসা ও উৎসবের জন্য বহুলাংশে জীববৈচিত্র্যের ওপরে নির্ভর করেন। যেমন দরিদ্র মানুষেরা বনের কাঠ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন, বনের শাকসবজি, ফলমূল খেয়ে থাকেন, বনের ভেষজ গাছ ও লতাপাতা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করেন এবং গাছের পাতা, ফুল নানা উৎসবে রঙের কাজে লাগান।
কৃষিতে নানান কীটপতঙ্গ বিভিন্ন রকমের ভূমিকা রাখে। গাছগাছালি অম্লজান জোগায়। জলবায়ু পরিবর্তন জীববৈচিত্র্য নষ্ট করলে মানুষের যাপিত জীবনে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে।
পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা পরিবেষ্টিত একটি নিচু ব-দ্বীপের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। সুতরাং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
১৯৮০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আবহাওয়া কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের নিমিত্তে মোট ২৫০টির বেশি দুর্যোগ ঘটেছিল। তবে দেশের বিভিন্ন অংশে দুর্যোগের প্রকৃতি বিভিন্ন রকমের।
বাংলাদেশে সংঘটিত নানান দুর্যোগের মধ্যে ঝড় ও বন্যার অনুপাত ছিল প্রায় তিন-চতুর্থাংশ (৭৩ শতাংশ)। চরম উষ্ণতার অংশ ছিল ১০ শতাংশ, যার অন্যতম কারণ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। এর সঙ্গে রয়েছে ভূমিকম্প, লবণাক্ততা, ভূমিধস, খরা ইত্যাদি।
বন্যার প্রকোপ কমবেশি বাংলাদেশজুড়ে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বসবাস এবং নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস সেখানেই ঘটে থাকে।
খরাপ্রবণ এলাকা দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের জন্য একটা বিরাট সমস্যা।
বছরের মার্চ মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মৌসুমি খরা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে বহু কৃষকের জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।
বেশ কিছুদিন ধরেই বন্যা ও জলাবদ্ধতা নগর অঞ্চলেও বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করছে। শহরাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় এবং লবণাক্ততা বেশি ঘটে থাকে উপকূলীয় অঞ্চলে।
বাংলাদেশে ১৯৮০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে, তাতে প্রায় দেড় লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল এবং ছয় কোটি মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়েছিল।
এসব দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি টাকার মতো। জলবায়ু পরিবর্তন-উদ্ভূত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়কারী প্রভাব কাটিয়ে ওঠা ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য বেশ কষ্টকর—বিশেষত স্বল্প মেয়াদে।
যেমন শুধু ১৯৯৮ সালের বন্যাতেই অর্ধেকেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গৃহস্থালিগুলোর সম্পদের মূল্য ১৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং সে বছরের কৃষি উৎপাদনের প্রত্যাশিত মূল্য ২৪ শতাংশ পড়ে যায়। দুর্যোগের কারণে গৃহস্থালির খাদ্যলভ্যতা ও খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে।
সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্কুলে উপস্থিতিও কমে গেছে; কারণ, পারিবারিক ব্যয়ের একটা বড় অংশ খাবারের জন্য ব্যয়িত হয়েছে।
স্বল্প মেয়াদে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার একটি বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মজুরি হারের ওপরে, বিশেষত কৃষি খাতের মজুরির ওপর।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, দীর্ঘ মেয়াদে বন্যা ও দীর্ঘ মেয়াদে মজুরির সম্পর্ক ইতিবাচক; কারণ, বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে বন্যা-পরবর্তী ফসল উৎপাদন, বিশেষত শুকনো মৌসুমের ফসল সাধারণত খুব ভালো হয়।
শহরের বস্তিতে যাদের বাস, তাদের শিক্ষার অভাব থাকতে পারে, কিংবা তাদের সম্পদের ঘাটতি থাকতে পারে, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের সক্ষমতা অনেক বেশি। জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রে প্রতিরোধকারী কৌশলগুলো দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন-পরিকল্পনার অংশ হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে জলবায়ু-উদ্ভূত দুর্যোগের সঙ্গে দারিদ্র্য ও সংনম্যতার একটি সংযোগ আছে—বিশেষত স্বল্প মেয়াদে। যদিও দরিদ্র জনগোষ্ঠীই মূলত দুর্যোগের শিকার হয়, তাঁরাই দ্রুত দুর্যোগ-পরবর্তী অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।
দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠী নানান কৌশল অবলম্বন করে।
যেমন তারা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে। যেহেতু তাদের সঞ্চয় নিতান্ত অল্প, তাই তাদের সুরক্ষার জন্য ঋণের কোনো বিকল্প থাকে না।
কখনো কখনো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যদি দুর্যোগ-পূর্ববর্তী অবস্থায় বিভিন্ন আয়-সূত্র থাকে, তাহলে তাদের পক্ষে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে সুবিধা হয়।
যেমন যেসব গৃহস্থালির সদস্যরা বিদেশে কাজ করেন, তাঁদের পাঠানো অর্থ দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সাহায্য করে।
যদিও বন্যা-পরবর্তী সময়ে স্বল্পমেয়াদি অস্থায়ী স্থানীয় অভিবাসন দেখা যায়, কিন্তু তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হিসেবে দেখা হয় না। মানুষ একেবারে বাধ্য না হহলে কোনো অবস্থাতেই তার স্থায়ী বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চায় না।
ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে সম্পদ ও সাহায্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনৈতিক যোগাযোগও একটি ভূমিকা পালন করে।
শহরের বস্তিতে যাদের বাস, তাদের শিক্ষার অভাব থাকতে পারে, কিংবা তাদের সম্পদের ঘাটতি থাকতে পারে, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের সক্ষমতা অনেক বেশি।
জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রে প্রতিরোধকারী কৌশলগুলো দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন-পরিকল্পনার অংশ হওয়া উচিত।
কারণ, চূড়ান্ত বিচারে জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত সমস্যাই নয়, এটি একটি উন্নয়ন-অন্তরায়ও বটে।
সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র