গত বুধবার প্রথম আলোর ৬–এর পাতায় আম্বিয়া খাতুন নামের এক বৃদ্ধার ছবি ছাপা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের ডালপট্টি থেকে তোলা এ ছবিতে দেখা যায়, ট্রাক থেকে রাস্তায় পড়ে থাকা ডাল কুড়িয়ে নিচ্ছেন ওই বৃদ্ধা। পেছনে ট্রাকটি দেখা না গেলেও চাকাগুলো দৃশ্যমান। বৃদ্ধার পরনে পুরোনো কাপড়, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল, পাশে পলিথিনের একটি ব্যাগ। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ডাল রাখার জন্যই ওই পলিথিনের ব্যাগ।
ছবিটি তুলেছেন প্রথম আলোর আলোকচিত্রী দিনার মাহমুদ। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁকে টেলিফোন করে ওই বৃদ্ধা সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চাই। তিনি জানান, আম্বিয়া খাতুনের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তিন বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের কেউ তাঁর দায়িত্ব নেননি। তবে ছোট মেয়ে তাঁদের বাড়ির পাশে একটি ছাপরা তুলে দিলে সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয়। ভিক্ষা করে এবং ডালপট্টির রাস্তায় পড়ে থাকা ডাল কুড়িয়েই তাঁর জীবন চলে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বৃদ্ধার বড় মেয়ের জন্ম, সেই হিসাবে তাঁর বয়স এখন ৭০ বছরের বেশি। কিন্তু রাষ্ট্র এই অসহায় বৃদ্ধার খোঁজ রাখেনি। তিনি কোনো ভাতা পান না। সন্তানেরাও খোঁজ নেন না। তাঁর কাছে জীবনের অর্থ রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ডাল, ভিক্ষায় পাওয়া একমুঠো চাল।
এর পাশাপাশি আরেকটি খবরের দিকে চোখ মেললে বাংলাদেশের অসংগতিটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বৃহস্পতিবার প্রথম আলো খবর দিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাস তিনেক আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতিটি গাড়ির দাম পড়বে প্রায় দেড় কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যয় হবে ৩৮১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। কয়েক দিন আগে আলাপ প্রসঙ্গে দুই ব্যবসায়ী জানান, তাঁরা ঋণপত্র খুলতে পারছেন না ডলার-সংকটের কারণে। ডলারের অভাবে ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খুলতে না পারলেও সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি কিনতে কোনো অসুবিধা হয় না।
নির্বাচনের সময় সাধারণত ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ইউএনওরা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের জন্য কেনা হচ্ছে স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি)। এটাকে অনেকে নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য সরকারের ‘উপঢৌকন’ বলে মনে করেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি এলে প্রথমে অর্থ মন্ত্রণালয় নাকচ করে দিয়েছিল। প্রথম আলো সম্পাদকীয় লিখেও ডলার–সংকটের সময়ে এ ধরনের বিলাসী প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কোনো কিছু কাজে আসেনি। মাঠপর্যায়ে যাঁরা নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবেন, সরকারকে তাঁদের ‘খুশি’ রাখতেই হবে।
কেবল নতুন গাড়ি নয়, প্রশাসনকে হাতে রাখতে সরকার আরও অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে। পত্রিকান্তরের খবরে জানা গেল, চলতি বছর অবসরে যাওয়া ১৯ সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে প্রশাসনের শীর্ষ দুই কর্মকর্তাসহ অন্তত ২১ সচিব চুক্তিতে কর্মরত। সংসদ নির্বাচনের আগে যে আটজন সচিবের অবসরে যাওয়ার কথা, তাঁদের মধ্য থেকে দু-তিনজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্যমতে, প্রশাসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ ৮৮ জন সচিব আছেন। তাঁদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অন্তত ২১ জনই চুক্তিবদ্ধ। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে অন্তত ১০০ কর্মকর্তা আছেন চুক্তিভিত্তিক। গত মাসে সরকার উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে ২২১ জনকে পদোন্নতি দেয়। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদেও পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। সবকিছুই আগামী নির্বাচনকে উপলক্ষ করে।
বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে করা ৫৯টি মামলার অভিযোগপত্রের মধ্যে ৫৮টিতে আসামি করা হয়েছে আবদুল হাইকে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই সময়ই ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেসিক ব্যাংকের ঘটনাকে ‘ডাকাতি’ বলে অভিহিত করলেও তখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বরং দুদক প্রথমে তাঁকে বাদ দিয়েই মামলা করেছিল।
কিন্তু নির্বাচনটি কীভাবে হবে, এখনো স্পষ্ট নয়। সরকারি দল সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করতে দৃঢ়সংকল্প। বিরোধী দল সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অনড়। দুই দলই প্রায় প্রতিদিনই সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা ও রোডমার্চ করে যাচ্ছে। অর্থনীতবিদদের মতে, এসব কর্মসূচি উপলক্ষে কিছু টাকা তো বাজারে আসছে। লোক আনতে বাস–ট্রাক ভাড়া করতে হয়। রাস্তার পাশে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার টানাতে হয়। কর্মসূচিতে আসা কর্মী–সমর্থকদের বিরিয়ানি খাওয়াতে হয়। কিন্তু এসবের খরচটা কারা জোগান দেয়? টাকাটা যদি ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে আসে, তাহলে ধরে নিতে হবে ব্যাংকের টাকা লোপাট করেই তাঁরা এটা দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহল থেকে বিএনপির কর্মসূচির অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হয়েছে। সরকারি দলের নেতাদের অভিযোগ, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেতারা যে কোটি কোটি টাকা লুটপাট ও বিদেশে পাচার করেছিলেন, তা এখন কর্মসূচিতে ব্যয় করছেন। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় বিএনপি কর্মসূচি করলে অন্তত কিছু টাকা দেশে আসছে।
কিন্তু গত ১৫ বছরে দেশ থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে, সেটা ফেরত আনার উপায় কী। যে আমলেই অর্থ পাচার হোক না কেন, তা গুরুতর অপরাধ। এই যে পিপলস লিজিংয়ের পি কে হালদার দেশ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেলেন, তার জন্য নিশ্চয়ই বিএনপি–জামায়াতকে দায়ী করা যাবে না। এটি ঘটেছে আওয়ামী লীগ আমলে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া যখন শুরু হলো, তখন তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। সম্প্রতি এক মামলায় তাঁর ২২ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। বর্তমানে ভারতের কারাগারে আছেন। যদি তাঁকে দেশে ফেরত আনা না যায়, ২২ বছরের স্থলে ৪৪ বছর কারাদণ্ড হলেও তো কোনো লাভ নেই। পি কে হালদারের মামলায় যেসব রাঘববোয়ালের নাম এসেছে, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন খবর জানা নেই।
বিরোধী দলের কোনো নেতাকে গায়েবি মামলায় ধরলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ‘আইন নিজস্ব গতিতে চলবে’। বাস্তবে আইন যে নিজস্ব গতিতে চলে না, পি কে হালদার ও আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর ঘটনাই তার প্রমাণ।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুদকের করা এক মামলায় বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের চার সদস্য হাইকোর্টে আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেছেন। গতকাল শুক্রবার টেলিফোনে কথা হয় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আবদুল হাই ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা আগাম জামিনের আবেদন করলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা তালিকায় আসেনি।
বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে করা ৫৯টি মামলার অভিযোগপত্রের মধ্যে ৫৮টিতে আসামি করা হয়েছে আবদুল হাইকে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই সময়ই ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেসিক ব্যাংকের ঘটনাকে ‘ডাকাতি’ বলে অভিহিত করলেও তখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বরং দুদক প্রথমে তাঁকে বাদ দিয়েই মামলা করেছিল।
সরকার আগেভাগে পি কে হালদার ও আবদুল হাই বাচ্চুদের পাকড়াও করলে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার ঠেকানো যেত। নির্বাচনের আগে সরকারকে নকল অপরাধী বা গায়েবি মামলার আসামিদের নিয়ে টানাটানি করতে হতো না।
আওয়ামী লীগ সরকার যে উন্নয়নের রোল মডেল তৈরি করেছে, তার সুফল থেকে নারায়ণগঞ্জের আম্বিয়া খাতুনেরাও পুরোপুরি বঞ্চিত হতেন না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি