যখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বাড়িতে বোমাবর্ষণ করে ওদের হত্যা করে, তখন রাশার বয়স ছিল ১০ বছর। ওর ভাই আহমেদের ১১।
১০ বছর বয়সী বাচ্চার হইহুল্লোড় করে পাড়া মাথায় তোলার কথা। সে কেন শেষ ইচ্ছার কথা লিখে যাবে?
একটা খাতার রুলটানা কাগজে নিজের শেষ ইচ্ছা লিখে গেছে মৃত্যুর আগে ১০ বছর বয়সী রাশা:
‘আমার ইচ্ছা, আমি যদি শহীদ হই বা মারা যাই, তোমরা আমার জন্য কেঁদো না। তোমরা কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। যারা অভাবী, তাদের আমার জামাকাপড়গুলো দিয়ে দিয়ো। খেলনাগুলো ভাগ করে দিয়ো রাহাফ, সারা, জুডি, লানা আর বাতুলের মধ্যে। পুঁতির মালাগুলো দিয়ো আহমদ আর রাহাফকে। আমাকে প্রতি মাসে পকেট খরচ দিতে ৫০ শেকেল করে। সেটা রাহাফকে ২৫ আর আহমেদকে ২৫ করে ভাগ করে দিয়ো। রাহাফকে দিয়ো আমার গল্পের বইগুলো। আর তোমাদের অনুরোধ করি, আমার ভাই আহমেদকে তোমরা বকা দিয়ো না। এই ইচ্ছাগুলো তোমরা রেখো।’
আমার ১০ বছর বয়সী ভাতিজি রাশা যে মৃত্যুর আগে একটা উইল লিখে রেখে গেছে, এ কথা আমরা কেউ জানতাম না। এ কথা জানানোর সুযোগও সে পায়নি। রাশাকে আমরা দাফন করি একই কবরে ওর ভাই ১১ বছর বয়সী আহমেদের সঙ্গে। বোমার আঘাতে আহমেদের মুখের অর্ধেকটাই উড়ে গিয়েছিল। ওদের বাড়িতে বিমান হামলা হয়েছিল ৩০ সেপ্টেম্বর।
ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর সামনে দাঁড়ালে মনে পড়ে, ছোট বাচ্চাদের প্রাণহীন লাশের দিকে মা-বাবার ছুটে যাওয়ার কথা। সে যে কী ভয়াবহ আচ্ছন্ন করে ফেলা এক আতঙ্ক! সে কথা কী করে ভোলা যায়?
কয়েক মাস আগে, গত ১০ জুন, রাশাদদের ভবনটিতে আরেকবার বোমাবর্ষণ হয়েছিল। ইসরায়েল সেদিন দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ফেলেছিল। পুরো পরিবারকে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা গিয়েছিল। সামান্য চোট ছাড়া তেমন আর কিছু হয়নি। বের হয়ে এসে ওরা ঠাট্টা করে বলছিল, পরিবারে দুটি বাচ্চা আছে, জনপ্রতি একটা করে বোমা ছুড়েছে ওরা।
আহমেদ ও রাশা সারা রাত কাফনের কাপড় পরে ঠান্ডা হাসপাতালের মেঝেতে পাশাপাশি শুয়ে ছিল। পরের দিন সকালে আমরা ওদের একই কবরে পাশাপাশি শুইয়ে রেখে আসি। চিরকালের জন্য।
সেবার রাশা আর আহমেদ বেঁচে গিয়েছিল। আরও কয়েক মাস যুদ্ধ, ভয় এবং ক্ষুধায় বেঁচে থাকবে বলেই হয়তো। রাশা তার উইলে বলেছিল, কেউ যেন তার বড় ভাই আহমেদকে বকা না দেয়। আহমেদ যেমন দুষ্টু, তেমন মেধাবী। রাশা জানত না যে ওর ভাই আরেক বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। তাই সে তার ২৫ শেকেলের উত্তরাধিকারী করে গেছে ভাইকে।
রাশা আর আহমেদের জন্ম এক বছরের ব্যবধানে। তাদের বড় হওয়ার কথা ছিল একসঙ্গে। হয়তো মায়ের মতো পিএইচডি করত। কিন্তু ওরা ভয়, ক্ষুধা আর আতঙ্কের জীবন একসঙ্গে কাটিয়ে মারাও গেছে একসঙ্গে।
হয়তো এই জগতের সমান্তরাল অন্য কোনো জগৎ আছে। সে জগতে হয়তো শিশুদের হত্যা করা ক্ষমার অযোগ্য যুদ্ধাপরাধ। আমাদের পৃথিবীতে রাশা আর আহমেদকে হত্যা করলে কেউ শাস্তি দেয় না।
ইসরায়েল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ১৬ হাজার ৭০০–এর বেশি শিশুকে হত্যা করেছে। অন্তত ১৭ হাজার শিশু তাদের মা–বাবাকে হারিয়েছে।
আমি এই লেখায় শুধু একটি ঘটনার কথা বললাম। এই ঘটনার বেদনাকে যদি ১৬ হাজার ৭০০ গুণ বাড়াতে পারতাম, তবু কি পাঠককে বোঝানো যেত গাজার কষ্টের আর দুঃখের তীব্রতা?
রাশা যখন তার শেষ ইচ্ছা লিখছিল, কী চলছিল ওর মনে? চারপাশের মানুষগুলো নিহত হচ্ছে, এসব তো সে প্রতিদিনই দেখত। রাশা নিজেও কি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল? আহা! একটা ১০ বছরের শিশু নিশ্চিত মৃত্যু জেনে উইল লিখে যাচ্ছে!
গাজার জনসংখ্যা ২৩ লাখ। এর অর্ধেক ১৮ বছরের কম বয়সী। এবার ভাবুন তো, গাজার আরও কত শিশু রাশার মতো মৃত্যু নিয়ে এমন চিন্তাভাবনা করছে? রাশার শেষ ইচ্ছা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। কী জানি এ রকম আরও কত উইল ধ্বংসস্তূপে হারিয়ে গেছে।
এই লেখাটা লিখতে লিখতে অবাক হয়ে ভাবছি, এই অন্ধকারে কোন ধ্বংসস্তূপের ভেতরে কে জানে, গাজার কোথায় কোন শিশু তার শেষ ইচ্ছা লিখে রাখছে।
আহমেদ ও রাশা সারা রাত কাফনের কাপড় পরে ঠান্ডা হাসপাতালের মেঝেতে পাশাপাশি শুয়ে ছিল। পরের দিন সকালে আমরা ওদের একই কবরে পাশাপাশি শুইয়ে রেখে আসি। চিরকালের জন্য।
১৬ হাজার ৭০০ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এই পৃথিবীতে কেউ কি কাঁদছে ওদের জন্য? সেই কান্নার শব্দ শুনতে পাই না কেন?
● আসেম আলনাবিহ গাজার একজন পিএইচডি গবেষক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন